TRENDING:

তিস্তাপারের দেবেশদা খেলাটায় জিতেই গেলেন শেষমেশ...

Last Updated:

দেবেশদা যা বিশ্বাস করতেন, সেই জীবনটাই বেঁচেছেন। আমি ছবির এমন দর্শক জীবনে আর দ্বিতীয় দেখিনি। দেবেশ রায়ের প্রয়াণে স্মৃতিচারণ করলেন হিরণ মিত্র।

impactshort
ইমপ্যাক্ট শর্টসলেটেস্ট খবরের জন্য
advertisement
১৯৯৮-১৯৯৯ সাল। শুরু হল তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-র মহড়া। প্রথম শো হয় রবীন্দ্রসদনে। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উপন্যাসটাকে নাট্যরূপ দিয়ে যখন অনুমতি নিতে গেলেন সুমন (নাট্যকার সুমন মুখোপাধ্যায়), দেবেশদা অদ্ভুত শর্ত দিলেন। কঠিন এবং ব্যয়সাপেক্ষ শর্ত। সেটাই ছিল কাজটার একমাত্র চ্যালেঞ্জ। দেবেশদা বলেন, শেষ ড্রেস রিহার্সালটা উনি দেখবেন। সেই মহড়া যদি ওঁর অপছন্দ হয় তবে এই নাটক মঞ্চস্থ করার অনুমতি তিনি দেবেন না। ২৬ টা স্টেজ রিহার্সাল, এত খরচখরচা করার পরে, ঠিক শো-এর আগে যদি দেবেশদা বেঁকে বসেন তবে কাজটা বন্ধ হয়ে যাবে, এই চ্যালেঞ্জটা আমরা নিয়েছিলাম।
advertisement

বহু ঘটনা ছিল তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উপন্যাসটায়। মহড়াকক্ষে বহু ঘটনা বাদ দিতে হয়। সুমনের কাজ ছিল একটি ঘটনার সঙ্গে অন্যটিকে গাঁথা, এবং তাকে শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া, যেখান থেকে বোঝা যাবে বাঘারুর অবস্থানটা কী, বাঘারু কে, বাঘারু সমাজকে কেন প্রত্যাখ্যান করে। এই গোটা ব্যাপারটা স্বচ্ছ ভাবে ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। তার জন্যে বহু ইমোশানাল সিকোয়েন্স তৈরি করেও বাদ দিতে হয়েছে। বারবার দেখতে হতো আটোসাঁটো দিকটা নষ্ট না হয়ে যায়। নাট্যরূপ দেওয়া নাট্যকারের একটা কাজ। আর মহড়াকক্ষে সম্পাদনা আরেকটা কাজ। সেই কাজটা দক্ষ হাতে সামলেছিলেন সুমন।

advertisement

নাটকের গান বাছাই ছিল আরেকটি কঠিন কাজ। গানগুলো যিনি সেই সময়ে গেয়েছিলেন, পরে চাকরি বাঁচানোর জন্য তিনি একসময়ে নিজেকে সরিয়ে নেন। আসলে এই নাটকটা নিয়ে বিরাট বিতর্ক হয়, কারণ পরোক্ষ ভাবে হলেও কামতাপুরী আন্দোলনকে এই নাটকটা সমর্থন করেছিল। তৎকালীন বাম সরকার এই নাটককে ভালভাবে নেয়নি। ওই সময়ে গোটা বাংলায় তিস্তার মানের কোনও নাটক হয়নি,অথচ তাঁকে কোথাও পুরস্কৃত করা হয়নি। এর পরে নান্দীকার সোজন বাদিয়ার ঘাট করে, এই ধাঁচেই। ভারতের সমস্ত ব্যারেজই সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। নদীগুলিকে ধ্বংস করেছে। অরণ্যবাসীকে ধ্বংস করেছে, এবং ব্যবসায়ীদের মদতই দিয়েছে। তিস্তাপারের বৃত্তান্তও তিস্তা ব্যারেজ-সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটা চিৎকার।

advertisement

দেবেশ রায়ের উপন্যাস তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-কেই নাট্যরূপ দেন সুমন মুখোপাধ্যায়।

খালেদবাবুর লেখায় পড়েছি, যে নাটকের মঞ্চসজ্জা তিনি করবেন তাঁর স্ক্রিপটও তিনি পড়তেন না। গল্পটা শুনে বুঝে নিয়ে নিজের মতো করে মঞ্চটাকে গড়ে তুলতেন। আমি ঠিক উল্টোটায় বিশ্বাস করি। নাটক প্রতিদিন জন্মায়, প্রতিদিন মারা যায়। ফলে তাঁর প্রতিটি সংলাপ অনুধাবন না করলে আমি কাজটাই করতে পারব না। আমি সার্কাস বা ম্যাজিক কোনওটাই জানি না, কিন্তু মঞ্চ আমার অভিনেতা, তাঁর মান-অভিমান রয়েছে। এখন এই প্রাণটা পুরোটাই প্রতিষ্ঠিত হয় মহড়াকক্ষে। আমি এ ছাড়া কোনও আরোপে বিশ্বাস করি না। কাজেই এই নাটকের মহড়ায় যেতাম। সেখানে মঞ্চস্থাপত্যের কিছু ছিল না। সামান্য কয়েকটা বেঞ্চ থাকত শুধু। সেখানে বসেই ছবি আঁকতাম। সেখান থেকেই গড়ে ওঠে জঙ্গল-ব্যারেজের সেই সব দৃশ্য।

advertisement

হিরণ মিত্রর আঁকা দেবেশ রায়ের প্রতিকৃতি।

আমি এই নাটকের জন্য ৩০ টা প্রপ বানিয়েছলাম। এই ৩০টা প্রপের ৩০০ রকমের কাজে ব্যাবহার হত। তিস্তার কাজ কী ভাবে করেছি আগে কখনও লিখিনি। আজ বলি,আমি তিস্তায় পিছন থেকে সামনে এসেছিলাম। আমি প্রথমেই ব্যারেজটা ডিজাইন করেছিলাম। ওই ৩০ টা প্রপ ব্যবহার করেই ব্যারেজটা করা। শেষে এই ব্যারেজ দিয়ে বাঘারু হেঁটে চলে যায় বাচ্চাটাকে কাঁধে নিয়ে।

advertisement

৩০ জন পুরুষ অভিনেতা ছিল, তাই ৩০ টা প্রপ।তাঁদের শরীরের ওজন ও উচ্চতা অনুযায়ী একেকটা প্রপ তাঁরা ব্যবহার করতেন। অভিনেতা অভিনেত্রী স্টেজেকে কী ভাবে ব্যবহার করবেন, কী ভাবে বদলে ফেলবেন, তা মহড়াতেই ঠিক করেছিলাম। প্রতিদিন আমি যে ছবি আঁকতাম তা নিয়েই কর্মশালা হত মহড়ার পরে। সেখানে আলো ডিজাইনার দীপক মুখোপাধ্যায়ও থাকতেন। তিস্তা তো নানা মঞ্চে হচ্ছিল। বিচারসভার জন্য দুটো পর্দা তৈরি করতে হয়েছিল আমায়। কারণ রবীন্দ্রসদন ও অ্যাকাডেমির মঞ্চের মাপ আলাদা। পর্দায় যে ছবিগুলো আঁকতে হয়েছিল তা কমবেশি ৩৫ ফুট/১৬ ফুট মাপের। সেই ছবি হারিয়ে গিয়েছে।

যেখানে শুরু করেছিলাম মানে দেবেশদার সেই শর্ত, সেইটা বলি। আমরা মহড়াতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, এই নাটক দেবেশদার ভাল লাগবে। উনি বাতিল তো করেননি, নাটক দেখে এত উচ্ছ্বসিত হলেন যে, কলকাতায় যত শো হয়েছে সব শো-তে এসেছেন দেবেশদা। আমি আর দেবেশদা পাশাপাশি বসতাম। একেক দিন একেক জায়গায় বসতেন দেবেশদা। আমার আর দেবেশদার একটা খেলা ছিল, কে কতবার এই নাটকটা দেখছে, সেই খেলা। আমি খেলায় হেরেই গিয়েছিলাম। আমি সামান্য কম দেখেছি নাটকটা। তাই দেবেশদা দেখা হলেই বলতেন, হিরণ আমি কিন্তু জিতে গেছি।

দেবেশদার একটা বিরল গুণের কথা বলে শেষ করি। উনি যা বিশ্বাস করতেন, সেই জীবনটাই বেঁচেছেন। আমি ছবির এমন দর্শক জীবনে আর দ্বিতীয় দেখিনি। গ্যালারিতে ঢুকতেন সবার আগে, বেরোতেন সবার পরে। ছবির সঙ্গে ওঁর একটা আদানপ্রদান চলত ওই গোটা সময়টা। আমি সন্দীপ সরকারের ছবি দেখা দেখেছি। দেবেশদা সবার থেকে এগিয়ে। এমন দর্শক আজ আর নেই। যেমন নেই দেবেশদার মতো অবিশ্বাস্য মানুষ।

সেরা ভিডিও

আরও দেখুন
১৭ রাজ্য পাড়ি দিয়ে শান্তির বার্তা — স্কুটিতে একা অভিযানে বর্ধমানের শিক্ষিকা
আরও দেখুন

-হিরণ মিত্র।

বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
তিস্তাপারের দেবেশদা খেলাটায় জিতেই গেলেন শেষমেশ...
Open in App
হোম
খবর
ফটো
লোকাল