আসলে উৎসব এলে মানুষ বিধিনিষেধ ভুলে মেতে উঠবে। আর তার ফলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যাবে। আমরা দেখেছি, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছর পুজোয় বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল। এ বারও তার ব্যতিক্রম নয়।
advertisement
অর্থাৎ চলতি বছরের পুজোও সেই বিধিনিষেধের গেরোয়। ইতিমধ্যে মণ্ডপে ঢোকার ক্ষেত্রে জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এর পাশাপাশি, কোনও এলাকায় ভিড় ও জমায়েত যাতে না-হয়, সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে তৎপর প্রশাসন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধগুলি কতটা মেনে চলা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন উঠলেও সরকার (Government) এ বিষয়ে যথেষ্ট কঠোর।
গত বছর উৎসবের মরসুম পেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বাড়-বাড়ন্ত শুরু হয়। আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। গোটা দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এই পরিস্থিতি যাতে আর এই বছর তৈরি না-হয় তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
দুর্গাপুজো-সহ একাধিক উৎসবের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের তো ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছেই। এর পাশাপাশি উৎসবের মরসুম শুরু হতেই যত বেশি সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব, সেই চেষ্টা চালানো হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় যাতে কোভিড সংক্রমণের হার কম থাকে, তার জন্য সে সব এলাকায় ক্যাম্প করেও গণ-টিকাকরণ করা হচ্ছে।
উৎসবের মুখে করোনা থেকে বেশ কিছুটা স্বস্তি মিলেছিল। দৈনিক সংক্রমণের হার কমেছিল অনেকটাই। সঙ্গে মৃত্যুর হারের গ্রাফও ছিল নিম্ন মুখী। এমনকি কয়েক দিন আগে বেশ কয়েকটি রাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্যতে নেমে এসেছিল। তবে কেরল, তামিলনাড়ু-সহ বেশ কিছু রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি চিন্তা বাড়িয়েছে। কারণ সেই সব রাজ্যে করোনা পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
সব কিছুর কথা মাথায় রেখে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোভিড নিয়ন্ত্রণে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
গত মাসের শেষের দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল যে, দেশের জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে কোভিড নিয়ন্ত্রণে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৫ (Disaster Management Act, 2005) অনুযায়ী যে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেটা আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এর আগে যে নোটিফিকেশন জারি করা হয়েছিল, তা অগাস্ট মাসে প্রকাশ করা হয়েছিল।
বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এটাও জানানো হয়েছে যে, আসন্ন উৎসবের মরসুমে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। উৎসব পালন করা হবে, কিন্তু উৎসবে অংশ নেওয়া প্রত্যেককে সচেতন থাকতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেদের সুরক্ষিতও রাখতে হবে। কোভিড প্রোটোকল যাতে সবাই মেনে চলে, সেই বিষয়েও কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কোভিড ১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর থেকেই বেশ চিন্তায় রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ উৎসবে প্রচুর মানুষ একত্রিত হবেন। আর পুজো মণ্ডপ, মেলা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রচুর মানুষ জড়ো হলে তো সেখানে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানা সম্ভব হবে না। ফলে কোভিড সংক্রমণের আশঙ্কা অনেকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দিয়েছেন, চলতি বছরের শেষের দিকে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে দেশে। আর এই পরিস্থিতিতে ভিড় বা জমায়েতে রাশ টানতে না-পারলে তা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে।
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
যে কোনও রকম জমায়েতে নজরদারি চালানোর উপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনীয় সব রকম পদক্ষেপ করতে হবে।
রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির কাছে স্পষ্ট নির্দেশিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন যদি পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোনও রকম জরুরি বিধিনিষেধ জারি করতে চায়, তা হলে সেটা তারা অনায়াসে করতে পারবে।
রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কোভিড সংক্রমণের হার কেমন, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, হাসপাতালগুলিতে কোভিড বেডের সংখ্যা, ICU বেডের সংখ্যা ইত্যাদি রেকর্ড রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনকে সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে বলা হয়েছে। বেশি মাত্রায় সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না-পড়তে পারে, তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছে।
ধরা যাক, নির্দিষ্ট কোনও এলাকায় করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। আগে থেকে যদি এমন কোনও পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হয়, তা হলে পুরো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
ফাইভ ফোল্ড স্ট্রাটেজি (five-fold strategy):
করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্র ফাইভ ফোল্ড স্ট্র্যাটেজি নেওয়ার কথা জানিয়েছে। কী সেই স্ট্র্যাটেজি? সেই পাঁচটি স্ট্র্যাটেজি হল--
টেস্ট (Test)
ট্র্যাক (Track)
ট্রিট (Treat)
ভ্যাকসিনেশন (Vaccination)
কোভিডের সমস্ত প্রোটোকল মেনে চলা (adherence to COVID-appropriate behaviour)
করোনা টিকাকরণ প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর করার পরিকল্পনা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যত দ্রুত সম্ভব বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে করোনা টিকা পৌঁছে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে দেশের প্রতিটি জেলাশাসকের দফতরকেও এই পরিস্থিতিতে অতি সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনও সমস্যা হলে দ্রুত তার মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।
পাশাপাশি, উৎসবের সময় যাতে সবাই মাস্ক পরে থাকেন এবং দূরত্ব বিধি মেনে চলেন - সে বিষয়েও কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ এই নির্দেশ না-মানেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলেও জানানো হয়েছে।
যে সব এলাকায় কোনও সংক্রমণ নেই অথবা খুবই কম সংক্রমণ রয়েছে, সেই সব এলাকায় যাতে নতুন করে সংক্রমণ না-বাড়ে সে দিকেও নজর রাখতে বলা হয়েছে।
উৎসবের সময় যাতে কোনও অঘটন না-ঘটে, সেই দিকেও সকলকে নজর রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন স্তর থেকে করোনার সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে।
বাড়ির বাইরে বেরোলে সবাইকে মাস্ক পরে থাকার জন্য বারবার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের সচেতনতামূলক প্রচারের জন্য ক্যাম্প করা হতে পারে। বিভিন্ন সংগঠন ইতিমধ্যেই মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিলি করার উদ্যোগ নিয়েছে।
মাস্ক পরা অথবা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলা ছাড়া করোনার মতো মারণ ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার একটাই মাত্র পন্থা রয়েছে। আর সেটা হল- টিকা বা ভ্যাকসিন।
জায়গায় জায়গায় টিকাকরণ ক্যাম্প হয়েছে এবং সেই সঙ্গে সকলকে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে নিতে অনুরোধও জানিয়েছে সরকার। টিকাকরণ নিয়ে প্রচারও চালানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকাকরণ দ্রুত হারে হলে রোগের ভয়াবহতা অনেকাংশেই কমে যাবে এবং দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে।