আপেক্ষিক আর্দ্রতা (Humidity) কমে যাওয়ার কারণে এটি ঘটে। বর্ষার তুলনায় শীতকালে বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম থাকে। তাই শীতের সময় ত্বক (Skin) ও চোখে আর্দ্রতার সমস্যায় ভুগি আমরা। ত্বক অনেক বেশি ক্ষতি প্রতিরোধী। তবে, শীতকালে আমাদের চোখের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। শুষ্ক চোখের সমস্যা হলে নানান অস্বস্তি, জ্বালাপোড়া দেখা দিতে পারে। জোরালো আলো সহ্য করতে না পারা, ঝাপসা দেখা, লাল হওয়া কিংবা চোখের ভেতর ও বাইরে পিচ্ছিল আঠাল পদার্থ তৈরি হতে পারে। তবে কয়েকটি জিনিস মাথায় রাখলে এই সমস্যা হবে না বা হলেও তা থেকে স্বস্তি মিলতে পারে। পরামর্শ দিচ্ছেন চক্ষুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. সত্যপ্রসাদ বালকি (Dr.Satya Prasad Balki)।
advertisement
আমাদের চোখ প্রতিনিয়ত দূষণের (Pollution) সংস্পর্শে আসে। তবে, দূষণ, ধুলিকণা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য চোখের নিজস্ব প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা রয়েছে। সেগুলি গল তিন-স্তর টিয়ার ফিল্ম (Three-Layer Tear Film) এবং পলক ফেলা (Blinking)। টিয়ার ফিল্মটি তিনটি স্তরের সমন্বয়ে গঠিত-একটি অভ্যন্তরীণ মিউসিন স্তর (Mucin Layer), এটি জেলির মতো পদার্থ, যা মূলত অন্য দু'টি স্তরকে চোখের পৃষ্ঠে নোঙর করে, জলের মতো মাঝের স্তরটি নিয়েই টিয়ার ফিল্মের বেশিরভাগ অংশ গঠন হয়। আর একেবারে বাইরের তৈলাক্ত স্তর রয়েছে, যা অন্য দু'টি স্তরকে ঢেকে রাখে এবং বাহ্যিক আঘাত থেকে চোখকে রক্ষা করে। অন্য দিকে, চোখের পলক ফেলা গাড়ির উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারের মতো আচরণ করে। যে কোনও ধুলো বা ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করে এবং টিয়ার ফিল্মকে সতেজ করে। এই প্রক্রিয়া আমাদের চোখকে সবসময় পরিষ্কার এবং আর্দ্র রাখে। চোখে যথেষ্ট পরিমাণে জল তৈরি না হলে বা সেই জল লুব্রিক্যান্ট হিসেবে যথেষ্ট না হলে চোখ কড়কড় করে, জ্বালা জ্বালা ভাব অনুভূত হয়। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।
শুষ্ক চোখের উপসর্গ:
অস্পষ্ট দৃষ্টি: শুষ্ক চোখের একটি সাধারণ উপসর্গ হল অস্পষ্ট দৃষ্টি। বেলা বাড়ার সঙ্গে শুষ্কতা বাড়ে, ফলে ঝাপসা দেখা যায়।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া: চোখের শুষ্কতার আর একটি লক্ষণীয় উপসর্গ হল চোখ লাল হয়ে থাকা। চোখের সাদা অংশে থাকা রক্তনালীগুলো ফুলে ওঠার ফলে চোখ লাল হয়ে যায়। মূলত মেইবোমিয়ান গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করার কারণে চোখের এই লালচে ভাব ও প্রদাহ হতে পারে।
চোখ থেকে জল পড়া: চোখ থেকে অতিরিক্ত জল পড়াও শুষ্ক চোখের একটি উপসর্গ। চোখ থেকে জল পড়ার অর্থ হল টিয়ার ফিল্ম চোখকে যথেষ্ট আর্দ্র করতে পারছে না। তাই শরীর শুষ্ক চোখকে আর্দ্র করতে জরুরি ভিত্তিতে অশ্রু উৎপাদন করে। যাদের চোখ থেকে অতিরিক্ত জল পড়ে তারা বাষ্পীভূত শুষ্ক চোখের সমস্যায় ভোগেন।
চোখ ভারী বা ক্লান্তি: চোখের শুষ্কতার অন্যতম উপসর্গ হল চোখ ভারী হয়ে আসা বা ক্লান্তি অনুভব করা। চোখে যখন জলের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হয়ে যায় তখন চোখ বার বার পলক ফেলে চোখের পৃষ্ঠকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। ফলে চোখে ক্লান্তি অনুভূত হয়।
আলো সংবেদনশীলতা: চোখের শুষ্কতায় চোখ আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এই সমস্যাকে ফটোফোবিয়াও বলা হয়। ফটোফোবিয়া আক্রান্ত রোগীরা হঠাৎ জোরাল আলো আলোতে আসলে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
চোখে কিছু পড়ার অনুভূতি: চোখে আর্দ্রতা না থাকলে ন্যাচারাল লুব্রিকেশন বা প্রাকৃতিক মসৃণতা হারায়। ফলে চোখে কিছু পড়েছে এমন ধরণের অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। বারে বারে চুলকাতে থাকে।
পলক ফেলতে অসুবিধা: চোখের শুষ্কতার কারণে ন্যাচারাল লুব্রিকেশনের অভাব হয়। চোখের পাতা ফেলার সময় অস্বস্তি অনুভব হতে পারে।
জ্বালাপোড়া: চোখের আরামের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ লুব্রিকেশন দরকার। চোখকে আর্দ্র রাখার জন্য মেইমবাম অর্থাৎ চোখের তৈলাক্ত পদার্থ নিঃসরণ হয়। চোখের শুষ্কতায় ভোগা রোগীরা চোখে বা চোখের পাতায় জ্বালাপোড়া অনুভব করে।
এখনকার দিনে শিশু, বয়স্ক-সহ আমরা প্রত্যেকেই প্রায় অত্যধিক গ্যাজেট ব্যবহার করি। কাজের জন্য একটানা তাকিয়ে থাকতে হয় কম্পিউটার বা ল্যাপটপের দিকে। বাড়িতে ফিরেও স্মার্টফোন বা ল্যাপটপেই চোখ আটকে থাকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চোখ। শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে শুষ্কতা আসে, তা চোখের স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ করে। সুতরাং এটি যাতে না ঘটে তার জন্য আমরা কী কী করতে পারি?
ভালো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। চোখের পাতাগুলিকে নন-টিয়ার শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে
চোখের পাতার লোমে কোনও ধুলো বা ক্রাস্ট জমা হতে দিলে চলবে না। কারণ এটি টিয়ার ফিল্ম গঠনে বাধা দেয় এবং সংক্রমণের আধার হিসাবে কাজ করে। যারা চোখের মেক আপ ব্যবহার করে, তাদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। অ-রাসায়নিক পণ্য ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহারের পর ভালো ভাবে চোখের পাতা পরিষ্কার করতে হবে। এরজন্য় নরম কাপড় বা তুলোর ব্যবহার করতে হবে।
যদি কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করা হয়। তবে দিনে ৬-৭ ঘন্টার বেশি সেগুলি পরা যাবে না। হাতের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী লুব্রিকেন্ট ড্রপ ব্যবহার করতে হবে।
শীতকালে চোখের পাতার উপর একটি উষ্ণ কম্প্রেস ব্যবহার করা আরামদায়ক অনুভূতি দেয়। পাশাপাশি পাতা থেকে তেল নিঃসরণকে সর্বোত্তম রাখতে সাহায্য করে। যা টিয়ার ফিল্মের তৈলাক্ত স্তরের জন্য অপরিহার্য। এয়ার হিউমিডিফায়ারের ব্যবহার ঘরে আর্দ্রতার মাত্রা সঠিক বজায় রাখতে সাহায্য করে। যা শুষ্ক চোখ প্রতিরোধ করে এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও উপকার হয়।
এই আবহাওয়ায় বাইরে বেরোনোর সময় এটা নিশ্চিত করুন যে চোখ সরাসরি ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে আসছে না। দুইচাকার গাড়ি চড়লে অবশ্যই চশমা বা হেলমেট পরতে হবে।
দীর্ঘ সময় কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ না রেখে মাঝেমাঝে বিরতি নিতে হবে। সুযোগ পেলেই সবুজ গাছপালার দিকে তাকাতে হবে। যা শুধুমাত্র চোখের জন্যই নয়, ঘাড় এবং পিঠের জন্যও ভালো।
ঘন ঘন ও জোরে জোরে চোখের পাতা ফেলতে হবে। এতে চোখের তরল পদার্থগুলি বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে কর্নিয়াকে ভিজিয়ে রাখবে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে না থেকে ঘন ঘন পলক ফেলার অভ্যাস করতে হবে।
প্রয়োজনীয় লুব্রিকেন্ট আই ড্রপগুলি ব্যবহার করতে হবে। এই ড্রপগুলি টিয়ার ফিল্মকে পরিপূরক এবং পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে।
সঠিক আলোর ব্যবহার প্রয়োজন। খুব কম আলো বা অন্ধকারে যেমন কাজ করা যাবে না, তেমনই অযথা কম্পিউটার ও মোবাইলের ব্রাইটনেস বাড়ালে হবে না। চোখের লেভেলে মনিটর রাখতে হবে। যাতে চোখ ও ঘাড় সোজা থাকে।
কম্পিউটার মনিটরে ও চশমায় অ্যান্টিগ্লেয়ার স্ক্রিন এবং চশমায় অ্যান্টি রিফ্লেকটিভ গ্লাস ব্যবহার করাও জরুরি।
ধূমপান শুষ্ক চোখের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। ধূমপায়ীদের শুষ্ক চোখের প্রবণতা বেশি থাকে। পারলে একেবারের ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে।
চোখের স্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুম নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। শোওয়া সময় ফোন ব্যবহার করা এড়িয়ে চলতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন ঘুম চোখের পাশাপাশি মন ও শরীরের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে হবে। জল খেলে শরীর আর্দ্র থাকে। অতিরিক্ত কফি অ্যালকোহল এবং ক্যাফিনযুক্ত অন্যান্য পানীয় শরীরের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। সেগুলি পান করা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে জলযুক্ত ফল যেমন তরমুজ, শসা, স্ট্রবেরি, পিচ ইত্যাদি খেতে হবে।
খাদ্য তালিকায় ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার রাখতে হবে। প্রাকৃতিক তেল চোখের আর্দ্রতা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। ডিম, শিয়া বীজ, তেলযুক্ত মাছ, আখরোট, ফ্লেক্স বীজ ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৩ অ্যাসিড থাকে।