কোভিড ভ্যারিয়ান্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে সব ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়েছে সেগুলিও অনেক সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, কোভিডের নতুন যে ভ্যারিয়ান্টগুলি আসছে সেগুলি করোনার প্রথম স্ট্রেনের থেকে অনেক শক্তিশালী এবং অত্যন্ত দ্রুত হাতে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় কোভিড ভ্যাকসিন নিলেও নতুন ভ্যারিয়ান্টের উপর সেই সব ভ্যাকসিনগুলি সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। যার ফলে কোভিড ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজের প্রয়োজন পড়ছে।
advertisement
আরও পড়ুন- কোভিড ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যা জেনে রাখা দরকার
বর্তমানে বিভিন্ন টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা এবং সরকারের তরফে করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ তৈরির জন্য আলোচনা করছে। ইতিমধ্যে আমেরিকা ও ইজরায়েলের তরফে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। করোনা প্রস্তুতকারী সংস্থা জনসন অ্যান্ড জনসন (Johnson & Johnson) সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টে সংস্থা জানিয়েছে যে তাদের তৈরি বুস্টার ডোজ করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের (Coronavirus Delta Variant) উপর যথেষ্ট কার্যকরী।
বুস্টার ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরী?
করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁরা জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার পর নির্দিষ্ট দিন অতিক্রম করার পর ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। মূলত যাঁদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি তাঁদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা অত্যন্ত বেশি দেখা দেয়। শুধু বয়স্করা নন, যাঁরা একদম শুরুর দিকে কোভিড ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন তাঁদের ক্ষেত্রেও করোনা ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেহেতু নির্দিষ্ট সময় সময় করোনা ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে তাই যাঁদের ভ্যাকসিনের দু'টি ডোজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে তাঁরাও একটা সময় পর ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ফাইজার (Pfizer) এবং মর্ডানার (Moderna) তৈরি ভ্যাকসিন, যেগুলি মূলত mRNA ভ্যাকসিন, সেগুলির ক্ষেত্রে সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমতে থাকে। এমনকী যেগুলি সিঙ্গল শট ভ্যাকসিন, যেমন জনসন অ্যান্ড জনসনের ক্ষেত্রেও একই চিত্র সামনে এসেছে। তবে এই ভ্যাকসিনগুলি যতদিন পর্যন্ত সঠিকভাবে কার্যকর থাকে ততদিন করোনার ভয়ঙ্কর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
এর পরেই প্রশ্ন আসে কেন আমাদের বুস্টার শট নেওয়া অত্যন্ত জরুরি?
বুস্টার শট নেওয়ার কারণ একটাই- করোনা ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে না কমে তার ব্যবস্থা করা।
মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার অর্থ কী?
কোভিড ভ্যাকসিনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞদের মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতিকে বেছে নিচ্ছেন। তাঁরা মনে করছেন মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতিটি ঠিক কী? ধরে নেওয়া যাক কোনও ব্যক্তি তাঁর প্রথম ডোজের ক্ষেত্রে কোনও একটি সংস্থার ভ্যাকসিন নিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ডোজের ক্ষেত্রে অথবা বুস্টার ডোজের ক্ষেত্রে অন্য সংস্থার ভ্যাকসিন ডোজ নিচ্ছেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ (Mix And Match Vaccination)।
বিশ্বের অনেক দেশই ইতিমধ্যে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল (Angela Merkel) মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন নিয়েছেন। তিনি প্রথম ডোজ নিয়েছিলেন অ্যাস্ট্রোজেনেকা (AstraZeneca) ভ্যাকসিন এবং সেকেন্ড ডোজে নিয়েছেন মডার্না ভ্যাকসিন।
কোভিড বুস্টার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও কি মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করা যেতে পারে? এটা কতটা সুরক্ষিত?
করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে যেহেতু ইয়োরোপের দেশগুলি মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতি অবলম্বন করছে, তখন বুস্টার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ অনুসরণ করা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে অনেক তথ্যই সামনে এসেছে যেখানে প্রমাণিত হয়েছে কোভিড ১৯-এর বুস্টার ডোজ মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতি মেনে দেওয়া সম্ভব এবং এর মধ্যে ঝুঁকি নেই। এই বিষয়ে সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (Centre for Disease Control and Prevention) জানিয়েছে, “যাঁরা ফাইজারের করোনা ভ্যাকসিন নিয়েছেন অথবা মর্ডানার ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাঁরা তৃতীয় বার mRNA ভ্যাকসিন নিতে পারেন। তবে তিন বারের বেশি mRNA ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত নয়।’’বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতিতে কেউ যদি একই গোত্রীয় ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন সেক্ষেত্রে ঝুঁকির সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।
মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতি মেনে চললে ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা বাড়ে?
ল্যানসেটের (Lancet) একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ অ্যাস্ট্রোজেনেকা ভ্যাকসিন ভারতে যার নাম কোভিশিল্ড (Covishield) তার সঙ্গে যদি কোনও mRNA ভ্যাকসিনের মিশ্রন ঘটানো হয় তাহলে করোনার বিরুদ্ধে অনেক বেশি কার্যকর হয়। এমনকী বুস্টার ডোজের ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত নিরাপদ বলে জানানো হয়েছে।
বর্তমানে অনেকেই রয়েছেন যাঁরা এখনও কোভিড ভ্যাকসিন নিতে পারেননি। অনেকে আবার প্রথম ডোজ নিয়েও দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, তাঁরা দ্বিতীয় ডোজ মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতিতে নিতে চাইলে নিতেই পারেন। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা। আর ঝুঁকিও অনেকটাই কম। মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ পদ্ধতি অবলম্বন করলে কোনও ভ্যাকসিন সঠিক সময়ে না পাওয়া গেলেও অন্য ভ্যাকসিন নেওয়া সম্ভব।
তবে করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমের দিকে অনীহা তৈরি হলেও পরবর্তীতে সেই সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। সরকার ও বিশেষজ্ঞদের তরফে বারবার সচেতন করা হচ্ছে এবং করোনা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বাধা কাটিয়ে ওঠার ফলে টিকাকরণের হার বাড়ছে। গণহারে টিকাকরণ করার জন্য বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকাতেও টিকা ক্যাম্প করা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তরফেও টিকাকরণ করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে বিভিন্ন কোভিড প্রোটোকল মেনে চলার জন্য সরকারের তরফে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি হাত ধোয়া ও ভিড় এড়িয়ে চলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে অবশ্যই প্রত্যেকে যেন ভ্যাকসিন নেয় সেই বিষয়েও আবেদন জানানো হচ্ছে।