২৬ বছরের অভিলাষা হরিয়ানার বাসিন্দা। ২০১৮ সালে তিনি আর্মি এয়ার ডিফেন্স কর্পসে (Army Air Defence Corps) কমিশন পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এস ওম সিং বরাক (S Om Singh Barak)। ২০১১ সালে তিনি অবসর নেন। সানাওয়ার লরেন্স স্কুল (The Lawrence School, Sanawar) থেকে পাস করার পর ২০১৮ সালে দিল্লির টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি (Delhi Technological University) থেকে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (B Tech in Electronics and Communication Engineering) পাশ করেন অভিলাষা। আর্মি এভিয়েশন কর্পসে যোগদানের আগে বেশ কয়েকটি পেশাদার সামরিক কোর্সে পাস করেন তিনি। এছাড়াও বাহিনীর এয়ার ডিফেন্স ইয়ং অফিসার্স কোর্সে 'এ' গ্রেড পান তিনি। এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট এবং আইন পরীক্ষাও একবারে পাশ করেন। অভিলাষা বলেছেন, "২০১১ বাবার অবসর নেওয়ার পর আমি বুঝতে পারি বাহিনীর জীবন কীভাবে আমাদের জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। যেদিন দাদাকে পাস আউট প্যারেডে দেখি সেদিনই আমি ঠিক করে ফেলি আমার জীবনের লক্ষ্য। যখন আমি কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য ফর্ম পূরণ করছি তখনও স্থল বাহিনীর যুদ্ধের পাইলট হিসাবে মহিলাদের নেওয়া হত না। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস ছিল যে আগামীদিনে সেনাবাহিনীতে মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হবে।"
advertisement
অভিলাষার এই সাফল্য এই মুহূর্তটি দেশের জন্য একটি গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে। আগামীদিনে ভারতীয় সেনার গুরুত্বপূর্ণ পদে আরও মহিলার আসার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে যা তাৎপর্যপূর্ণ।
এনডিএ এবং স্থায়ী কমিশনের উপর সুপ্রিম কোর্টের রায়: ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছিল। শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছিল যে সেনাবাহিনীতে মহিলা অফিসারদের স্থায়ী কমিশন (Permanent Commission) দেওয়া হবে, এক্ষেত্রে কেন্দ্রের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল আদালত। আদালত বলেছিল, "মহিলাদের স্থায়ী কমিশন না দিয়ে লিঙ্গ বৈষম্য করা হয়েছে।" আদালত নির্দেশ দিয়েছিল যে তিন মাসের মধ্যে সমস্ত শর্ট সার্ভিস কমিশনে (Short Service Commission) থাকা মহিলাদের অফিসারদের স্থায়ী কমিশনের জন্য বিবেচনা করতে হবে, তা সে ১৪ বছর বা ২০ বছর চাকরি সম্পূর্ণ হোক না কেন।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে বলেছিল যে মহিলারা সামরিক কলেজগুলিতে পড়তে এবং স্থায়ী কমিশনের জন্য যোগ্য হতে পারে। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট মহিলাদের ন্য়াশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির প্রবেশিকা পরীক্ষা (National Defence Academy Entrance Exams) দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিল। মহিলাদের এনডিএ (NDA) পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিতে অস্বীকার করার জন্য সরকারের সমালোচনা করেছিল আদালত। তারা বলেছিল, "এটি লিঙ্গ বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে একটি নীতিগত পছন্দ।"
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরই এনডিএ মহিলাদের জন্য আলাদা ঘের, কেবিন, অতিরিক্ত ওয়াশরুম তৈরি করে তার পরিকাঠামো পরিবর্তন করছে এবং ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে মহিলা ক্যাডেটদের স্বাগত জানাতে একটি কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করছে।
মহিলা ক্যাডেটদের জন্য এনডিএ-তে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলির বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অরবিন্দ ভাটিয়া। তিনি জানিয়েছিলেন যে প্রাথমিকভাবে একটি বিদ্যমান স্কোয়াড্রনকে আলাদা করা হবে এবং প্রথম ব্যাচের জন্য সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো তৈরি করা হবে। তিনি যোগ করেছিলেন যে মহিলা ক্যাডেটদের জন্য আলাদা আলাদা মহিলা প্রশিক্ষক, গাইনোকোলজিস্ট সহ ডাক্তার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা কর্মীদের নিয়োগ করতে হবে।
এর আগে, মহিলারা শর্ট সার্ভিস কমিশনের (SSC) অধীনে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারতেন। স্থানীয় কমিশন পেতেন না। স্থায়ী কমিশনে অফিসারদের দীর্ঘ সময়ের জন্য কাজ করতে হয়। নয়ের দশকের গোড়ার দিকে সশস্ত্র বাহিনীর শিক্ষা এবং আইন বিভাগে মহিলাদের শর্ট সার্ভিস কমিশনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রকৌশল, বুদ্ধিমত্তা এবং লজিস্টিকস সহ সারা বছর ধরে মহিলারা আটটি নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন।
স্থায়ী এবং শর্ট কমিশন কী?
একটি স্থায়ী কমিশন অবসর গ্রহণ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে একটি কর্মজীবনকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেখানে একটি শর্ট সার্ভিস কমিশন দশ বছর স্থায়ী হয়, দশ বছর শেষে পদত্যাগ বা স্থায়ী কমিশনে রূপান্তর করার বিকল্প যদিও থাকে। একজন আধিকারিক স্থায়ী কমিশন না পেলে চার বছরের মেয়াদ বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৯৯৩ সাল থেকে মহিলারা অফিসার হিসাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করছেন। তাঁদের প্রাথমিকভাবে 'স্পেশাল এন্ট্রি স্কিম' (Special Entry Scheme)-র আওতায় আনা হয়েছিল, যা পরে শর্ট সার্ভিস কমিশনে (SSC) রূপান্তরিত হয়েছিল। ২০০৮ সালে জজ অ্যাডভোকেট জেনারেল (Judge Advocate General) এবং আর্মি এডুকেশন কর্পস (Army Education Corps) স্ট্রিমগুলিতে মহিলাদের জন্য স্থায়ী কমিশনের সুবিধা চালু করা হয়েছিল।
আর গত বছরের অক্টোবরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৯ জন মহিলা অফিসারকে স্থায়ী কমিশন দেওয়া হয়েছিল। এটি দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল। কারণ ৭১ জন মহিলা অফিসার, যাঁদের স্থায়ী কমিশন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, তাঁরা সেনাবাহিনীতে স্থায়ী কমিশনের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টকে বলেছে যে ৭১ জন অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩৯ জনকে স্থায়ী কমিশনের জন্য যোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, অন্য ২৫ জনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার সমস্যা রয়েছে এবং বাকিরা মেডিক্য়ালি অযোগ্য।
যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক: সাড়ে তিন হাজারের বেশি মহিলা সামরিক বাহিনীতে কাজ করেন। সরকার ২০১৫ সালে মহিলাদের ফাইটার স্ট্রিমে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী (Indian Air Force) প্রস্তাব অনুমোদন করে। তার আগে পর্যন্ত মহিলাদের সামনের সারির যুদ্ধের দায়িত্ব (Front-Line Combat Duties) দেওয়া হত না। মহিলাদের এখনও যুদ্ধজাহাজ, ট্যাঙ্ক, এবং পদাতিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। কমব্যাট মিশনে নৌবাহিনীর (Indian Navy) মেরিটাইম রিকোনাইস্যান্স এয়ারক্র্যাফ্টে মহিলারা পাইলট এবং পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পদাতিক এবং আর্মার্ড কর্পসের মতো জায়গায় মহিলাদের অন্তর্ভুক্তি দীর্ঘকাল ধরে আলোচনার কেন্দ্রে, বিশেষ করে ভারতে। যদিও এই ইস্যুতে অনেক মতামত রয়েছে, কেউ কেউ যুক্তি দেয় যে পদক্ষেপের জন্য প্রথমে একটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। মহিলাদের সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলিতে পদাতিক বাহিনীর পদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই ভারতে এই পদক্ষেপের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে।
তবে মহিলারা 'চলতে থাকবে'
ক্যাপ্টেন অভিলাষা আর্মি এভিয়েশন কর্পসের অন্তর্গত, যা ১৯৮৬ সালের নভেম্বরে গঠিত হয়েছিল। এই কর্পসের নেতৃত্বে একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার রয়েছেন। যিনি আর্মি এভিয়েশনের ডিজি হিসাবে পরিচিত। বছরের পর বছর ধরে আর্মি এভিয়েশন কর্পস তাদের ব্যপ্তি বাড়িয়েছে। চিতা, ধ্রুব, রুদ্র লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার (LCH) এবং ড্রোনের মতো নতুন ইউনিট যোগ হয়েছে কর্পসে। গত কয়েক বছরে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি বিভাগ ধীরে ধীরে মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং খুলে দিয়েছে। ২০১৮ সালে ভারতীয় বায়ুসেনার ফ্লাইং অফিসার অবনী চতুর্বেদী (Avani Chaturvedi) একা যুদ্ধবিমান চালানো প্রথম ভারতীয় মহিলা হয়ে ইতিহাস রচনা করেন। তিনি মিগ-২১ বাইসন (MiG-21 Bison) বিমান উড়িয়েছিলেন একা।
সরকার পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে মহিলাদের জন্য ফাইটার স্ট্রিম খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ফ্লাইং অফিসার হিসাবে কমিশন হওয়া তিন সদস্যের মহিলা দলের অংশ ছিলেন চতুর্বেদী। ২০২০ সালে তার ডর্নিয়ার মেরিটাইম বিমানে প্রথম ব্যাচের মহিলা পাইলট (Women Pilots) মোতায়েন করার ঘোষণা করেছিল নৌবাহিনী। একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপে, সেনাবাহিনী ২০১৯ সালে সামরিক পুলিশে মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে। মিলিটারি পুলিশের ভূমিকার মধ্যে রয়েছে পুলিশিং ক্যান্টনমেন্ট এবং সেনা স্থাপনা, সেনাদের দ্বারা নিয়ম ও শৃঙ্খলার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করা এবং শান্তি ও যুদ্ধের সময় সেনাদের জন্য রসদ বজায় রাখা।