মাল্টিপ্লেক্সগুলিতে রমরমিয়ে চলা ‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’-র পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ৷’ অথচ এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হবে না জয়দীপ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবি ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া আইকনিক সেই ওয়ার্ক অব আর্ট-এর নকলনবিশ৷ বরং একেন-প্রমথ-বাপির বেনারস পর্বকে বলা যায় সত্যজিৎ রায়ের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য৷ এ ছবি দেখার সময় ফেলুভক্তদের মনে বার বার তুলনা চলে আসবেই৷ তবে তাঁরা যে দিনের শেষে খুব হতাশ হবেন না, সে কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি৷
advertisement
ফেলুদাকে নিয়ে ইদানীং একের পর এক পরীক্ষা নিরীক্ষা, মন ছুঁয়ে না যাওয়া সিনেমা-সিরিজ দেখতে দেখতে হা-ক্লান্ত প্রদোষ অনুরাগীদের যে একেনবাবুর নতুন অভিযান ভাল লাগছে, তার অন্যতম কারণ অনির্বাণ চক্রবর্তীর অনবদ্য অভিনয় এবং পদ্মনাভ দাশগুপ্তর এক্সট্রা আর্ডিনারি সংলাপ৷ বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ রূপকে তাঁর তুরুপের তাস করেছেন পদ্মনাভ৷ এবং সেই সংলাপ তথা চিত্রনাট্যকে তেরা নম্বর বাক্সায় শুয়ে থাকা ছোরার মতো অর্জুনের হাতের নিপুণ নিশানায় দর্শকের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন অনির্বাণ৷ তাঁর সংলাপের টাইমিং যেন মাস্টার ব্লাস্টারের কভার ড্রাইভের মতোই নিখুঁত৷
সুজন দাশগুপ্তের লেখা কাহিনির গোয়েন্দা একেনবাবুকে বরাবরের মতোই নতুন করে পেশ করেছেন পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়৷ তাঁর এই ছবিতে ফেলুদা, তোপসে, জটায়ু, মছলিবাবার আসর, মগনলাল মেঘরাজ, বিকাশ সিংহ, শশীবাবু, ঘোষালবাড়ি-সব্বাই আছে৷ তাদের আপনি দেখতে পাবেন না৷ কিন্তু নাজুক উপস্থিতি তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করবেন প্রতি সেকেন্ডে৷
আরও পড়ুন : কর্পোরেট অফিস সুখের হয়…কেমন হল শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ছবি ‘আমার Boss’? পড়ুন রিভিউ
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর মতো হু ডান ইট গোত্রীয় নয়৷ ‘দ্য একেন : বেনারসে বিভীষিকা’ বরং ‘সোনার কেল্লা’-র মতো থ্রিলার৷ ছবির প্রথমেই দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিস্ফোরণ তথা নাশকতা ঘটাতে এবং ছদ্মবেশ ধরতে সিদ্ধহস্ত জঙ্গি বেলাল মল্লিককে৷ ছবি জুড়ে তাকেই ধাওয়া করে যান একেনবাবু৷ বেলালের খেল তিনি কী করে খতম করবেন, তা দেখার জন্য টান টান উত্তেজনায় অপেক্ষা করতে হবে যবনিতা পতন পর্যন্ত৷ তার সঙ্গে মিশেছে খুন, মহার্ঘ্য শিল্প চোরাচালানের রহস্যও৷ ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ মূল গল্পে ফেলুদা গঙ্গায় ডুব দেবে গণেশমূর্তি উদ্ধার করতে৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে শ্যুটিংয়ে সমস্যা হবে বলে সিনেমায় ক্লাইম্যাক্স অন্যভাবে সাজান সত্যজিৎ রায়৷ বেলাল মল্লিককে হাতেনাতে ধরতে ত্রিশূলধারী একেন ডুব দিয়েছেন গঙ্গায়, সে দৃশ্য দেখানো হয়েছে ট্রেলারেই৷ কারণ খলনায়ক জবরদস্ত্ না হলে যে গোয়েন্দার মগজাস্ত্র ধার দেওয়ার জায়গাও থাকে না৷ এবং এই একেন-অভিযানের বড় পাওনা খলনায়কের ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়৷ মাঝে মাঝে বব বিশ্বাসের আমেজ ভেসে এসেছে বটে৷ কিন্ত পর্দায় প্রতিটা ছদ্মবেশ তাঁকে দুর্দান্ত মানিয়েছে৷ তাঁর মুখে আরও কিছুটা সংলাপ দিলে হয়তো ক্ষতিবৃদ্ধি হত না৷ পাশাপাশি একেনবাবুর সঙ্গে বেলালের বুদ্ধির টক্কর বা মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন আরও বেশি দেখানো যেত৷
ছবিতে পার্শ্বচরিত্রের কুশীলবদের মধ্যে আলাদা করে বলতেই হয় সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, সোমক ঘোষ, গৌরব চক্রবর্তী (এঁকে যে আবার কবে গোয়েন্দার চরিত্রে দেখা যাবে!), সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়, ইশা সাহা এবং স্বীকৃতি মজুমদারের কথা৷ প্রত্যেকের অভিনয় লাগসই৷ ইশার মেক আপ এবং স্বীকৃতির সংযত মাপা উপস্থিতি প্রশংসনীয়৷ ছবির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বারাণসী৷ রাবড়ি থেকে মশলাদার পান, অলিগলি, নৌকায় গঙ্গাসফর থেকে শুরু করে ক্লাইম্যাক্সে শ্মশানের ছাই মেখে খেলা ‘মাসান হোলি’৷ ভারি যত্নে ফ্রেমবন্দি করা হয়েছে প্রাচীন শহরের তরঙ্গকে৷
কোনও শিশুচরিত্র না থাকলেও একেনবাবুর এই ছবি ছোটদের ভাল লাগছে৷ কারণ আজকের ক্যাপ্টেন স্পার্কদের মনের বহু খোরাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছবির আনাচে কানাচে৷ শুধু গ্রুপ ছবিতে দামিনীর ছবিটা আলাদা করে বসানো হয়েছে, তা কিন্তু দর্শকদের নজরে ঠিক ধরা পড়ে গিয়েছে৷ জমজমাট ছবিতে ও জিনিস রয়ে গেল আকাশবাণীর লখনউ স্টেশনে আখতারি গজল হয়ে৷