বিনোদিনী দাসীর জীবনের মর্মস্পর্শী কাহিনী আমরা কমবেশি অনেকেই জানি। তবে নির্দেশক অবন্তী চক্রবর্তী বিনোদিনী দাসীর জীবনের ঘটনা আর নাট্য মুহূর্ত খানিকটা কোলাজের কায়দায় তুলে ধরেছেন। আর সবকিছুর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে নটী বিনোদিনীর নির্ভেজাল গভীর নাট্য প্রেম, অভিনয়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা।
অবন্তীর নিখুঁত নির্দেশনা ও প্রত্যেক শিল্পীর অনবদ্য অভিনয়ের পিরামিডের শীর্ষে শক্ত হাল ধরে বিনোদিনীর চরিত্রকে একাল সেকালের গণ্ডি পেরিয়ে জীবন্ত করে তুলেছে সুদীপ্তা চক্রবর্তীর স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়। সুদীপ্তা বরাবরই সুঅভিনেত্রী। জাতীয় পুরস্কার রয়েছে তাঁর নামের পাশে। মঞ্চে সাবলীল। সিনেমায় বিচক্ষণ। টিভির পর্দায় অনবদ্য এবং অসাধারণ সঞ্চালিকা। যাঁরা সুদীপ্তা চক্রবর্তীর সম্পর্কে জানেন বা খোঁজখবর রাখেন তাঁরা সুদীপ্তার এই গুণগুলি সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু 'বিনোদিনী অপেরা 'য় এক অন্য সুদীপ্তাকে আবিষ্কার করলেন দর্শকরা।
advertisement
মঞ্চে সুদীপ্তা শুধুমাত্র অভিনয় দিয়ে বিনোদিনী হয়ে ওঠেননি বরং অনুভব দিয়ে হয়ে উঠেছেন। বিনোদিনীর চরিত্রে সুদীপ্তা কোথাও যেন বহতি নদীর মত। যে প্রথা ভাঙে, প্রথা গড়ে, কিন্তু থেমে থাকে না। পুরুষশাসিত এই সমাজের সমস্ত বর্জ্য বহন করে সে এগিয়ে চলে। শেষ দৃশ্যে সুদীপ্তা যেখানে বিনোদিনী থেকে বেরিয়ে হয়ে উঠছেন সর্বকালের শোষিত-পীড়িত নারী। হয়ে উঠছেন আন্দোলনের প্রতীক। সপাটে চড় কষাচ্ছেন পুরুষশাসিত প্রচলিত সমাজের গালে । সেই দৃশ্যে সুদীপ্তার কান্না, তাঁর আর্তনাদ কোথাও যেন প্রত্যেক নারীর কান্না হয়ে উঠেছে। বিনোদিনীর চোখের জল কখন সুদীপ্তার চোখের জল হয়ে দর্শকদের চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে, তা পাটিগণিতের হিসেব দিয়ে বোঝানো মুশকিল। শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। সর্বোপরি সুদীপ্তা খুব সুন্দর ভারসাম্য বজায় রেখেছেন প্রতিটি দৃশ্য এবং সংলাপে।
এছাড়া গুর্মুখ রায়ের চরিত্রে সুজন মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয় সত্যি মনে দাগ কাটে। পাশাপাশি বিনোদিনীর জীবনের বাকি পুরুষদের চরিত্র যেমন কুমার বাহাদুর পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, রাঙাবাবু বিশ্বজিৎ দাস প্রত্যেকেই তাঁদের চরিত্রের সঙ্গে সমান সুবিচার করেছেন। তবে রসরাজ অমৃতলাল বসুর চরিত্রে তথাগত চৌধুরীর দুর্দান্ত অভিনয় সত্যি এই নাটকের একটি বড় পাওনা। সেই সঙ্গে চোখকে আরাম দেয় কোরিওগ্রাফি। সেট ডিজাইনও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। নানা রঙের মোটা দড়ির ব্যবহার অনেক রকম ইঙ্গিত বহন করে। প্রপসের এর ব্যবহারও যথাযথ।
সুদীপ্তা চক্রবর্তীর চাপা হাসি ও কান্না নাটকের সেরা প্রাপ্তি বলা যেতে পারে। সেই সঙ্গে সুদীপ্তাকে বাকি নারী চরিত্ররা যেভাবে সঙ্গ দিয়েছেন তাও এক কথায় অনবদ্য। তবে বিনোদিনী অপেরা নিছক একটি নাটক নয়। কোথাও যেন সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও পুরুষের গায়ের কালি অদৃশ্য অথচ সেই কালি নারীকে করে নির্বাসিত। তাই হয়তো তখনও বি থিয়েটার তৈরি হয়নি। কিংবা বলা চলে তৈরি হতে দেওয়া হয়নি। আজও বিনোদিনীর নামে কোনও রঙ্গমঞ্চ তৈরি হল না। শেষ দৃশ্যে বি থিয়েটারের কাট আউট সত্যি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন রেখে যায় কবে আমরা নটী বিনোদিনীর নামে একটি মঞ্চ পাব? আরও একটু স্পষ্ট করে বললে কবে আমরা লিঙ্গবৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সমান চোখে দেখতে শিখব?
অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের বাতানুকূল যন্ত্রের বিভ্রাট ছাড়া গোটা নাটকের বিস্তার ছিল মসৃণ।