নাটকের টানেই আর দর্শনের অধ্যাপক হয়ে থাকা হল না৷ হয়ে গেলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের অধ্যাপক৷ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বিভাগীয় প্রধান ‘শিশিরকুমার ভাদুড়ি’ অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন৷ পরিচালনা, অভিনয়ের মাঝেই কলম থেকে ঝরে পড়েছে ‘সাজানো বাগান’, ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘কালবিহঙ্গ’, ‘পরবাস’, ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘নরক গুলজার’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘চাকভাঙা মধু’, ‘মেষ ও রাক্ষস’, ‘মুন্নি ও সাত চৌকিদার’, ‘বৃষ্টির ছায়াছবি’, ‘যা নেই ভারতে’-এর মতো মণিমুক্তো৷
advertisement
নাট্যজগতের এই প্রতিষ্ঠান যখন বাংলা সিনেমায় এসেছেন অভিনেতা হিসেবে, তখন ধরা দিয়েছেন স্বকীয়তায় ভরা নতুন আঙ্গিকেই৷ দীর্ঘ কেরিয়ারে ‘গণশত্রু’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘দামু’, ‘শত্রু’-সহ একাধিক ছবি থাকলেও মনোজ মিত্র বাঙালির হৃদমাঝারে থাকবেন বাঞ্ছারাম হয়ে৷ তাঁর নিজের লেখা ‘সাজানো বাগান’ নাটক থেকেই তপন সিনহা বানিয়েছিলেন এই ছবি৷ শুধু এই ছবিতেই নয়, মনোজ সযত্নে রক্ষা করে গিয়েছেন বাংলা অভিনয়ধারার সজীবতাকেই৷ তাঁর অভিনয়ের সহজাত কৌতুকরস সঞ্চারিত হত খলচরিত্রের অভিনয়েও৷ নীচু লয়ে, কেটে কেটে সংলাপ বলার ধরন অনবদ্য এবং অনণুকরণীয়৷
মঞ্চ, বড়পর্দার পাশাপাশি মনোজ মিত্র দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন দূরদর্শনেও৷ আটের দশকের শেষে রাজা সেনের পরিচালনায় ১৩ পর্বের এই ধারাবাহিক মাইলফলক হয়ে আছে কলকাতা দূরদর্শনের ইতিহাসে৷ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাশ্বত উপন্যাসের মূল চরিত্র ‘হাজারি ঠাকুর’-কে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সৃষ্টিরসের অস্থিমজ্জায়৷ জীবনে শূন্য থেকে শুরু করা হাজারি বামুন যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, সেই ওঠাপড়াকে লাইট সাউন্ড ক্যামেরার বাইরে মূর্ত করে তুলেছিলেন মনোজ৷ পদ্ম ঝি-র ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং হাজারি বামুনের চরিত্রে মনোজ মিত্রের অভিনয়ের দ্বন্দ্ব, টানাপড়েন দাগ কেটে গিয়েছিল দর্শকমনে৷ আজকের চড়াদাগের সোপ অপেরার দিনে ছোটপর্দায় তাঁদের সেই অভিনয়ের সূক্ষ্মতা বিরলতম৷ সেই সূক্ষ্মতাকে উপজীব্য করেই নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্রের তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, বাসু চট্টোপাধ্যায়, শক্তি সামন্তর পরিচালনায়৷ মনোজ মিত্রের সঙ্গে অভিনয়ে সঙ্গত দিত তাঁর শরীরী ভাষাও৷ ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ তাঁর শারীরিক অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বরও অভিনয়ের মাধ্যম৷ তরুণ বয়সে অভিনয়ে বার্ধক্যযাপন তাঁর অভ্যাস ছিল অনেক আগেই৷ নিজের ঠাকুরদাকে কেন্দ্র করে লিখেছিলেন জীবনের প্রথম একাঙ্ক নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’৷ সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করতেন নিজেই৷ সেই মুনসিয়ানাই ফিরিয়ে এনেছিলেন বড় পর্দায়৷.
১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর সাবেক বাংলার খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে ভূমিষ্ঠ হওয়া অশোককুমার মিত্রের জ্যেষ্ঠ সন্তান মনোজের জীবনের সকালবেলায় স্বপ্ন ছিল কবিতা লেখা৷ সেই কবিতাই তিনি লিখে গিয়েছেন আজীবন, তাঁর অভিনয়ে৷ হেমন্তের সকালে থেমে গেলেন তাঁর ৮৭ তম জন্মদিনের কিছু দিন আগেই৷ পড়ে রইল বাঞ্ছারামের শিশি আর ভাঁড়৷ যাতে বন্দি আমাদের মন ভাল রাখার ঠিকানা৷ রেখে গেলেন বেচু চক্কোত্তির আদর্শ হিন্দু হোটেলের হাতা খুন্তিও৷ ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানোর রসায়নে পাক দেওয়ার জন্য৷