সাক্ষাৎকার শুরু করার আগে অভিষেকের প্রশ্ন, ভালো আছেন? পশ্চিমবঙ্গে ঝড়ে তো বেশ ক্ষতি হয়েছে।
প্র: তা হয়েছে। আপনার বাংলা তো বেশ পরিষ্কার।
উ: ঠিকঠাক বলার চেষ্টা করি। কিন্তু হিন্দিতে কথা বলি তো সবসময়, আপনি যেমন সাবলীল বাংলা বলছেন, সেটা পারি না। এখন আবার বাংলা স্পষ্ট বলার অভ্যেস করছি।
advertisement
প্র: ‘কালি টু’সিরিজের জন্য ঝালিয়ে নিয়েছিলেন, সেই প্র্যাকটিসই চলছে?
উ: বলতে পারেন। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে দারুণ লাগল। পাওলি অসাধারণ অভিনেত্রী। একসঙ্গে প্রথম শট দিতে গিয়ে, ওঁর চাহনি দেখে বুঝেছিলাম ও অভিনয় জানে। আর কলকাতার সেটের বাঙালি খাবার আহা। জিভে জল চলে এল। আসলে আমার স্ত্রী শুধু পোস্তো বানাতে পারেন। আর আমি কষা মাংস। শুধুমাত্র বাঙালি খাবারের টানেই কলকাতায় কাজ করতে পারি।
প্র: ‘রং দে বসন্তি’র এক মিনিটের চরিত্র, থেকে ‘পাতাল লোক’-এর সাফল্য, নিজেকেও কী আবাক করেছেন?
উ: হিন্দিতে বলবো, হয়রান তো নেহি হু। এটাই লক্ষ্য ছিল। জন্মেছি খড়গপুড়ে, বাবা প্যারা মিলিটারিতে ছিলেন। তাই অনেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কলকাতায় গেলাম, সেখান থেকে দিল্লি তারপর চেন্নাই। সেখানে তামিল শিখলাম। তামিল ছবি দেখলাম। সিনেমার প্রতি অজান্তেই ভালবাসা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাংলা, হিন্দি, তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, সব ভাষার ছবি দেখতাম।
প্র: আঞ্চলিক ছবির প্রতি আকর্ষণ রয়েছে আপনার?
উ: দেখুন অভিনয় আর বলিউড দু’টো সমার্থক শব্দ নয়। আমার কাছে চিরঞ্জিবী ততটাই বড় স্টার, যতটা অজয় দেবগণ। সমন্থা প্রভু ও আলিয়া ভাট দু’জনই আমার কাছে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সবচেয়ে ভাল অভিনেত্রী। সিনেমা একটা বড় ক্যানভাস। শুধু বলিউডে সেটাকে আটকে রাখতে চাইনি কখনও। অভিনয়ের বাণিজ্যিক দিকটার চেয়েও আমি শৈলির সঙ্গে জুড়ে থাকতে চাই।
প্র: অভিনেতাই হবেন সেটা ঠিক করলেন কবে?
উ: আমার মনে হয় চেন্নাইয়ে থাকাকালীন। পড়াশোনা ছাড়াও অন্য সৃজনশীল জিনিসের প্রতি বেশ নজর দেন ওখানকার লোকজন। প্রচুর মিউজিক্যাল প্লে দেখেছি। তারপর দিল্লিতে এলাম। একটা ঘটনা মনে আছে, খুব সম্ভবত ওই দিনই ঠিক করেছিলাম, অভিনয় জগতে কিছু করে দেখাবো।
প্র: কী ঘটেছিল?
উ: পড়াশোনায় ভাল ছিলাম না। খুব খারাপ নম্বর পেতাম। একদিন নাটকের মহড়া দিচ্ছিলাম। আমার একজন শিক্ষক বললেন, ‘মঞ্চই তোমার জায়গা, তুমি অভিনয় করে বড় হওয়ার চেষ্টা করো।’ কথাটা খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিলাম।
প্র: ভাগ্যিস নিয়েছিলেন, তাই তো ‘হাতোড়া ত্যাগি’-কে আমরা পেলাম। স্ক্রিপ্ট পড়ার সময় বুঝেছিলেন, এই চরিত্র আপনার কেরিয়ারের মাইলস্টোন হতে চলেছে?
উ: না একেবারেই এমন কিছু ভাবিনি। কিন্তু মনের মধ্যে একটা গাট ফিলিং ছিল। মনে হয়েছিল এই চরিত্রে যদি ঠিকঠাক অভিনয় করতে পারি, আমার জন্য অনেক দরজা খুলে যাবে। পরিচালকদের সঙ্গে আমার অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় করাতে পারব। এত ভালবাসা পাব ভাবিনি। প্রশংসা পাওয়ার পর, সিরিজটা আবার দেখলাম। কোথায় কতটুকু করেছি, তাতে কতটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি, মিলিয়ে দেখছিলাম।
প্র: এই সিরিজের জন্য আপনি কাস্টিং-ও করেছেন। এই নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে। সকলের প্রশ্ন, নিজেই নিজেকে কাস্ট করলেন কী করে? আমি জানতে চাইব কাস্টিং চলাকালীন ‘ত্যাগী’-র চরিত্রের জন্য অডিশন দেওয়ার কথা কখন মনে হল?
উ: দেখুন, সত্যি বলতে কখনও মনে হয়নি। সিরিজের চিত্রনাট্যকার সুদীপ শর্মা আমাকে এই চরিত্রের জন্য অডিশন দিতে বলেন। এটা ভীষণ কঠিন একটা চরিত্র, আমি নিজেকে এর যোগ্য কখনও ভাবিনি। আর কাস্টিং ডিরেক্টর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় না। ওই ক্ষমতাটা পরিচালকের হাতেই থাকে।
প্র: স্ক্রিপ্টটা অসম্ভব ভাল। অপনি তো একজন অভিনেতা, কাস্টিং করতে গিয়ে, কখনও ইচ্ছে হয়নি অভিনেতা হিসেবে এই সিরিজের অংশ হতে?
উ: আপনাকে মিথ্যে বলব না। মনে মনে ‘অনসারি’ হতে চেয়েছিলাম। বলেওছিলাম ‘অনসারি’-র জন্য অডিশন দিতে চাই। তবে ওই যে বললাম, কাস্টিং ডিরেক্টর শুধু অপশন দিতে পারে।
প্র: সেটা আপনার জন্য ভালই হয়েছে। ‘স্ত্রী’ ছবিতেও আপনি অপারশক্তি খুরানার চরিত্রটা করতে চেয়েছিলেন? কিন্তু আপনার চরিত্র ‘জানা’-ই ছবি মুক্তির পর বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
উ: এখন বুঝে গিয়েছি, আমার চেয়ে পরিচালকরা ঢের বেশি বোঝেন। আর নিজের মতামত প্রকাশই করব না। জানেন, আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম, যখন ‘স্ত্রী’-র পরিচালক আমাকে ‘জানা’ করার প্রস্তাব দেন। আমি ভাবতাম আমি খুব সিরিয়াস গোছের, এই সব ‘ত্যাগী’ টাইপের রোলই আমাকে মানাবে। এরও ব্যাক স্টোরি আছে। ছোটবেলায় আমার মুখ গোল ছিল। তাই আমাকে গোলা বলে ডাকতো বাড়ির সকলে। গোলা ইমেজ ভাঙার জন্য জোর করে একটু গম্ভীর হাবভাব করতাম। তবে ‘স্ত্রী’-এর সময় ব্যাপারটা খাটলো না। ‘পাতাল লোক’-এ আবার সিরিয়াস দিকটা এক্সপ্লোর করতে পেরেছি।
প্র: ‘হাতোড়া ত্যাগি’ হয়ে উঠেলেন কী করে? কারণ, এমন কাউকে কখনও দেখেননি, নৃশংস অথচ তাঁকে ঘৃণা করা যায় না।
উ: এরকম কাউকে দেখিনি ঠিকই। তবে মানসিকতাটা অচেনা নয়। আমাদের দেশে এখনও ফিউডালিসম রয়েছে। সমাজই ‘ত্যাগি’র মতো মানুষের জন্ম দেয়। দুর্বলকে দমন করলে সে কখনও না কখনও বিদ্রোহ করবে। আশপাশের পরিবেশ যদি বিষাক্ত হয়, তবে সে দানবই তৈরি হবে। সিরিজে সেভাবে নেই, কিন্তু আমি কানেক্ট করেছিলাম ‘ত্যাগি’র ছোটবেলার সঙ্গে। সমাজের কালো চেহারা দেখে, ভাল কিছু হতে পারে, এই বিশ্বাসই উঠে গিয়েছিল ওঁর। ছোটবেলা থেকে ও মনে বেদনা জমিয়ে রেখেছিল, তার বহিঃপ্রকাশ নেই। হয়তো ভালবাসা পেলে, ভাল পরিবেশ পেলে ও ‘বিশাল ত্যাগি’-ই হতো ‘হাতোড়া ত্যাগি’ নয়।
প্র: সংলাপ থাকলে অভিনয় করা বোধহয় একটু সোজা। গোটা শো-এ আপনার হাতে গোনা সংলাপ। কিন্তু এত কিছু বোঝাতে হবে, কঠিন ছিল?
উ: আপনি সিরিজ দেখেছেন, তাই বুঝবেন। ক্লাইম্যাক্স সিনটায়, রাগ, দুঃখ, অসহায়তা, বিট্রেয়ালের কষ্ট আরও কতো কিছু এক্সপ্রেস করার ছিল। কিন্তু একটাও সংলাপ নেই। কী করে করবো? নার্ভাস ছিলাম। শো রিলিজ করার পরও ভাবছিলাম, এতো কমপ্লেক্স ইমোশন দর্শককে বোঝাতে পেরেছি তো। এখন বুঝতে পারি, তখন আমার চরিত্রের মধ্যে কী কী অনুভূতি কাজ করছিল, সেটা দর্শক বুঝেছেন।
প্র: নীরজ কবি, জয়দীপ এঁরা সকলে দারুণ অভিনেতা, চিন্তা হয়নি কী ভাবে নিজের ছাপ ফেলবেন?
উ: সামনে ভাল অভিনেতা থাকলে আপনাকে শুধু রিঅ্যাকশন দিতে হয়, অভিনয় করার প্রয়োজন হয় না।
প্র: আপনি যাই বলুন, কিছুই না করলে, অনুরাগ কাশ্যপের মতো পরিচালক প্রকাশ্যে এত প্রশংসা করতেন না।
উ: অনুরাগ কাশ্যপ ও অমিতাভ বচ্চন আমার কাছে গুরু দ্রোণাচার্য। হাতে ধরে কিছু শেখাননি। কিন্তু ওঁদের থেকে যা শিখেছি, তা সারা জীবন কাজে লাগবে। অনুরাগ স্যার ভাল কাজের প্রশংসা সব সময় করেন।
প্র: বেস্ট কমপ্লিমেন্ট কোনটা?
উ: স্ত্রী বলেছেন যত সফল হোক না কেন, ও কিছুতেই ‘পাতাল লোক’ দেখবে না। আর মা খুব রেগে গিয়েছেন। আমাকে ফোন করে বকছেন রীতিমতো। জিজ্ঞেস করছেন ‘কে এসব বাজে চরিত্রে অভিনয় করাচ্ছে তোকে দিয়ে?’ পর্দায় তার মানে দারুণ খারাপ লোক হতে পেরেছি। এসব স্ত্রী-মায়ের না দেখাই ভাল। ওঁরা আমার কমেডিই দেখুক।
প্র: ২০০৮ থেকে কাজ করছেন নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মতো চরিত্র এত দিনে পেলেন। ধৈর্য্য ধরে, চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, কীভাবে সম্ভব?
উ: বিশ্বাস করবেন না হয়তো, অধৈর্য্য আগে কখনও হইনি, গত বছর হয়ে পড়েছিলাম। তাই এত কাজ করেছি। এখন তো আরও ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করব। শুধু ভাল চরিত্র এলেই করব। বেশি কাজ করতে চাই না। পাগলের মতো কাজ করলে সেটা অভিনয় নয়, প্রজেক্ট হয়ে যাবে। অর্থের বিনিময়ে কাজ। জীবনযাপনের জন্য কাস্টিং করি। অভিনয়টা প্যাশন। প্যাশন হয়েই থাক, নম্বর গেম করতে চাই না।