মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে যত ভয়: ভারতীয়রা বরাবর এমন বিনিয়োগ বিকল্প বেছে নেন যেখানে মেয়াদ শেষে মোটা মূলধন হাতে আসে। সবচেয়ে বড় কথা নির্দিষ্ট রিটার্ন পাওয়া যায়। এবং সুদের হার সম্পর্কে নিশ্চিন্ততা থাকে। এ দেশে ফিক্সড ডিপোজিট এবং রেকারিং ডিপোজিট এহেন জনপ্রিয়তার পিছনে এগুলোই সবচেয়ে বড় কারণ। শুধু তাই নয়, ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিসে ফিক্সড ডিপোজিট এবং রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। ভারতীয়রা ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিসকে বিনিয়োগের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসেবে দেখে। মিউচুয়াল ফান্ড এই ধরনের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। কারণ অনেক এএমসি বিনিয়োগকারীদের কাছে পরিচিত নয়।
advertisement
আরও পড়ুন: আজও কি ফের বদল জ্বালানির দামে? জানুন কলকাতার পেট্রোলের দর
মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি অবিশ্বাসের আরও একটা কারণ হল, অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই মনে করেন, এখানে বিনিয়োগ করলে নিশ্চিত রিটার্ন নাও পাওয়া যেতে পারে। এমনকী কষ্টার্জিত টাকা জলে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে বিশ্বাস অনেকের। তাছাড়া ‘মিউচুয়াল ফান্ডগুলি বাজারের ঝুঁকির সাপেক্ষে’ বলে সতর্কতাও দেওয়া হয়। এই কারণেই মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে ব্যাঙ্ক কিংবা পোস্ট অফিসের ফিক্সড ডিপোজিট বা রেকারিং ডিপোজিটের মতো নিরাপদ বিনিয়োগ বিকল্প হিসেবে ধরা হয় না। যাই হোক, এই ধারণা যত তাড়াতাড়ি ভাঙে ততই ভাল, কারণ এটা সত্যি নয়। মাথায় রাখতে হবে, একমাত্র মিউচুয়াল ফান্ডগুলি বিনিয়োগকারীকে মুদ্রাস্ফীতির সাপেক্ষে রিটার্ন দিতে পারে যদি তিনি বিনিয়োগ বুঝতে পারেন এবং বিনিয়োগকারী আর্থিক লক্ষ্য এবং ঝুঁকি প্রোফাইলের উপর নির্ভর করে বিনিয়োগ করেন।
আরও পড়ুন: নতুন করে শুরু করা যেতে পারে এই সব ব্যবসা! কম বিনিয়োগেই হয়ে যেতে পারেন মালামাল!
মিউচুয়াল ফান্ড কি নিরাপদ: দুটি উপায়ে বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। প্রথমত, মূলধন সুরক্ষা এবং নির্দিষ্ট আয়ের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা। দ্বিতীয়ত, যে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের টাকা ঝেঁপে পালিয়েছে সেখান থেকে বা সেই কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের থেকে নিরাপত্তা। মাথায় রাখতে হবে, কোনও বিনিয়োগই ১০০ শতাংশ ঝুঁকিমুক্ত নয়। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা দেশের বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড হাউস নিয়ে গবেষণা করে সেরা পারফর্মিং মিউচুয়াল ফান্ড বেছে নিয়েছেন।
মিউচুয়াল ফান্ড নতুনদের সামনে যে প্রথম বড় প্রশ্নটি নিয়ে আসে তা হল মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা নিরাপদ কি না। যেহেতু এই দেশের মানুষ বড় লাভের চেয়ে অর্থের সুরক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাই এই প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না'-এ দিতে চায়। কিন্তু, এর উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না'-এ দেওয়া যাবে না। কিছু জিনিস জানা দরকার, যার পরে বিনিয়োগকারী নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা আপনার জন্য সঠিক এবং নিরাপদ কি না। তাই বিনিয়োগ করার আগে বিনিয়োগকারীকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি জানতে হবে।
বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে কেউ পালাবে না: যদি কেউ মনে করেন মিউচুয়াল ফান্ডগুলো টাকাপয়সা নিয়ে রাতারাতি উধাও হয়ে যাবে, তাহলে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, মিউচুয়াল ফান্ড সম্পূর্ণ নিরাপদ। সকালে ঘুম থেকে উঠে কেউ দেখলেন মিউচুয়াল ফান্ডে যে টাকা বিনিয়োগ করেছেন তা গায়েব হয়ে গিয়েছে, এমনটা কোনও দিন হবে না। এতটা জোর দিয়ে কীভাবে এই কথা বলা যাচ্ছে? যেহেতু মিউচুয়াল ফান্ড কোম্পানিগুলি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া বা সেবি এবং অ্যাসোসিয়েশন অফ মিউচুয়াল ফান্ড ইন ইন্ডিয়া বা এএমএফআই-এর মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধান করা হয়, তাই কোনও ফান্ড হাউস বিনিয়োগকারীদের অর্থ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে না। কারণ সেবি-র বিধিগুলি কোনও সংস্থাকে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা সমস্ত অর্থ নগদে রূপান্তর করার অনুমতি দেয় না। কোম্পানিগুলোকে প্রতি মাসে জানাতে হয় তাদের কাছে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কত টাকা উঠেছে। তাই মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে কাজ করে এমন কোনও কোম্পানি বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে না।
পাশাপাশি বিনিয়োগের উপর রিটার্ন নির্ভর করে। এর সঙ্গে বাজার অস্থিরতাও দায়ী। কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না যে অমুক কোম্পানি কখনই ডুববে না। সাধারণত সব মিউচুয়াল ফান্ডই নির্দিষ্ট রিটার্ন দেয়, তা কম বা বেশি হলেও শেয়ার বাজারের উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। আরও একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, মিউচুয়াল ফান্ড হাউসগুলো খুব সহজে কিন্তু লাইসেন্স পায় না। ভাল ট্র্যাক রেকর্ড থাকতে হয়। ঠিক যেভাবে ব্যাঙ্কগুলো ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স পায়। সোজা কথায় বলতে গেলে, মিউচুয়াল ফান্ড হাউসগুলো ব্যাঙ্কের মতোই নিরাপদ।
নিজের কাছে সৎ থাকতে হবে: মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের প্রথম শর্ত হল বিনিয়োগকারীকে জানতে হবে তিনি উচ্চতর আয়ের জন্য বিনিয়োগ করছেন না কি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করছেন। বাজারে সব ধরনের কোম্পানি আছে। কেউ কেউ কম সময়ে বড় মুনাফা দিলেও ঝুঁকি বেশি থাকে। কেউ কেউ দীর্ঘদিন পর ভাল রিটার্ন দেয় এবং সেক্ষেত্রে ঝুঁকি কম। তাই বিনিয়োগ করার আগে মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কিত বিভিন্ন কোম্পানি এবং স্কিম সম্পর্কে পড়া উচিত। ইন্টারনেটে এরকম অনেক ওয়েবসাইট আছে, যেগুলো মিউচুয়াল ফান্ড স্কিমের সব ধরনের তথ্য দেয় এবং বিভিন্ন কোম্পানির তুল্যমূল্য বিচার করে। তাই মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কে একটু পড়লেই বিনিয়োগকারী তাঁর চাহিদা বুঝতে পারবেন এবং সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে পারবেন।
মিউচুয়াল ফান্ডে উচ্চ রিটার্ন পাওয়া যায়: মিউচুয়াল ফান্ডগুলি মূলধন সুরক্ষা বা নির্দিষ্ট রিটার্নের গ্যারান্টি দেয় না। অনেক বিনিয়োগকারীই এটা না পসন্দ। কিন্তু এটা ভাল জিনিস। কারণ মিউচুয়াল ফান্ডগুলি খারাপ বিনিয়োগ পণ্য হবে যদি তারা তা করে। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের প্রধান উদ্দেশ্যই হল প্রথাগত বিনিয়োগ বিকল্পগুলির থেকে অনেক বেশি হারে রিটার্ন পাওয়া। অর্থাৎ যাতে আয় বেশি হয়। উচ্চ রিটার্ন মিউচুয়াল ফান্ডগুলির আরও বিস্তৃত বাজার এক্সপোজার এবং পেশাদার ব্যবস্থাপনার ফলাফল।
মিউচুয়াল ফান্ডগুলি ঐতিহ্যগত বিনিয়োগের তুলনায় আরো কর-দক্ষ। এর সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতিকে হারানোর মতো রিটার্ন অফার করে। এই দুটি সুবিধাই মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে পাকা বিনিয়োগকারীদের প্রধান পছন্দ করে তুলেছে। মিউচুয়াল ফান্ড থেকে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী লাভের উপর এমনভাবে কর আরোপ করা হয় যাতে রিটার্ন মার না খায়। এই তহবিলগুলি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগেই লাভজনক কারণ যত বেশি সময় বিনিয়োগ করা হবে, তত বেশি আয় হবে। মিউচুয়াল ফান্ডে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ পাওয়া যায়। ফলে আরও বেশি রিটার্ন আয় করার সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে, মিউচুয়াল ফান্ডগুলি উচ্চতর রিটার্ন দিয়েছে যা প্রথাগত বিনিয়োগ রিটার্নের তুলনায় বেশি এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রচলিত হারের চেয়েও। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে যে ঝুঁকি থাকে তা বিনিয়োগকে বৈচিত্রময় করে। এবং আর্থিক লক্ষ্য, সময় দিগন্ত এবং ঝুঁকি সহনশীলতার উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করে পরিচালনা করা যেতে পারে।
মিউচুয়াল ফান্ডে কি বিনিয়োগ করা উচিত: মিচুয়াল ফান্ড সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে এর মতো নিরাপদ বিনিয়োগ আর হয় না। ইক্যুইটি ফান্ডে বিনিয়োগের সময় স্বল্পমেয়াদি আয়ের ওঠানামা হতে পারে। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সঠিক মিউচুয়াল ফান্ড বেছে নেওয়া উচিত যা বিনিয়োগের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এবং হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে মিউচুয়াল ফান্ডে সবসময় দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগই লাভজনক। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে প্রচুর গবেষণা এবং খুঁটিনাটি পড়া উচিত। আক্রমণাত্মক, মধ্যপন্থী এবং রক্ষণশীলের মতো বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযুক্ত বিভিন্ন ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে।
পরিশেষে এই কথা বলাই যায়, অর্থ হারানোর ভয়ের চেয়ে সঠিক কোম্পানি এবং সঠিক স্কিম বাছাটা গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য, ইন্টারনেটে ঘেঁটে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞদের থেকে পরামর্শ নেওয়া যায়। এবং অবশ্যই বাজারের সাম্প্রতিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে হবে। নিরাপদ এবং অনিরাপদের সংজ্ঞা ঠিক কী, এটা শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীর উপরেই নির্ভর করে।