বিশ্বের বৃহত্তম টেক ট্রেড শো-গুলোর মধ্যে সিইএস অন্যতম। আগে কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স শো নামে পরিচিত ছিল। সারা বিশ্ব থেকে চমকপ্রদ উদ্ভাবনী গ্যাজেট নিয়ে এসে দেখানো হত এখানে। সে এক এলাহি আয়োজন। জীবনের সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক কীভাবে বদলে যায় তার একটা আভাস পাওয়া যায় এই শো থেকে। যেন এক নিখুঁত ক্রিস্টাল বল। অদূর ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কী হতে চলেছে তার পূর্বাভাস পাওয়া যেত এখান থেকেই।
advertisement
রিসার্চ ফার্ম টেকসপনেশিয়ালের প্রধান বিশ্লেষক অ্যাভি গ্রিনগার্ট বলছেন, ‘সিইএস হল ইকোসিস্টেমের স্বাস্থ্য বোঝার এবং কী ট্রেন্ড হতে চলেছে সেই প্রবণতাগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার সর্বোত্তম উপায়’। সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘পরবর্তী সম্ভাব্য বড় জিনিসটা এখানে দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে’। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ২০২৩ সালে কী হতে চলেছে এবং কোন ক্ষেত্রগুলো উদযাপনের জন্য প্রস্তুত, সে সম্পর্কে রইল সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা।
আরও পড়ুন: PNB: Punjab National Bank-এ অ্যাকাউন্ট আছে ফোনে এই নম্বর সেভ করুন, একটি কলে পাবেন লক্ষ টাকা!
মেটাভার্সের দিকে কয়েক কদম: মেটাভার্স নিয়ে অনেকেই অনেক রকম ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। কেউ কেউ তো অকাল মৃত্যুর পরোয়ানাও জারি করে দিয়েছেন। এসব নেহাতই গুজব। তবে হ্যাঁ, মেটাতে ক্রমাগত সংশয় এবং ঝামেলার মধ্যে মেটাভার্সের ভবিষ্যৎ কিছুটা অন্ধকার মনে হতে পারে। কিন্তু তাই বলে দাঁড়ি পড়ে যাচ্ছে না। সম্প্রতি ৯ হাজার গ্রাহকদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল অ্যাকসেঞ্চার। তার মধ্যে ৫৫ শতাংশই জানিয়েছেন, তাঁরা মেটাভার্সের ‘অ্যাকটিভ ইউজার’ হতে চান। অ্যাকসেঞ্চারের গ্লোবাল সফটওয়্যার এবং প্ল্যাটফর্ম লিড কেভান ইয়ালোভিটজ বলছেন, ‘মেটা অপটিমিস্টদের মধ্যে ৯০ শতাংশই নতুন বছরে বড়সড় লাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত’।
এর মধ্যে মেটাকে টক্কর দেওয়ার জন্য অন্য কোম্পানিগুলোও প্রস্তুত। এইচটিসি - যেটি ভিআর হেডসেটের ভিভ লাইন তৈরি করেছে — মেটার জনপ্রিয় কোয়েস্ট ২-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ডিজাইন করা একটি পোর্টেবল পণ্যকে খোলাখুলিভাবে রণাঙ্গনে আহ্বান করছে। শার্প এবং ক্যানন সহ অন্যান্য প্রতিযোগীরা প্রোটোটাইপ এবং অভিজ্ঞতা দেখানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে যা সাধারণ ব্যবহারকারীদের ভার্চুয়াল স্পেসে নিয়ে যাবে। এবং, কয়েক বছরের প্রত্যাশার পরে, এই বছর অ্যাপেল অবশেষে একটি পরিধানযোগ্য স্ক্রিন নিয়ে ব্যবহারকারীদের সামনে হাজির হতে পারে।
এর মানে এই নয় যে ব্যবহারকারী শীঘ্রই বিস্তৃত, নিমজ্জিত, ইন্টারঅপারেবল জগতের মধ্যে দিয়ে নিজেকে এগিয়ে যেতে দেখবেন। শুধু এটুকু বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা এখানেই থামছে না। এবং কোম্পানিগুলিও মোটেও হাল ছাড়ছে না।
প্রাচীর ঘেরা বাগান খুলতে শুরু করেছে: ম্যাটার্স নামক ইউনিফায়েড স্ট্যান্ডার্ডকে ধন্যবাদ। ২০২২ সেই বছর বলে মনে করা হয়েছিল যেখানে কানেক্টেড হোম গ্যাজেট - স্মার্ট লাইটবাল্ব, ভিডিও ডোরবেল, অভিনব থার্মোস্ট্যাট – সব একসঙ্গে নির্বিঘ্নে সামনে আসতে শুরু করেছিল। এই গ্যাজেটগুলোকে যে কোনও ভয়েস সহকারী বা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ম্যাটার্স মুক্তি পেতে কয়েক মাস দেরি হয়। সামনে আসে অক্টোবরে। তারপর বাজার কাঁপায়। যদিও অনেকে মনে করছেন ম্যাটার থেকে সর্বাধিক লাভ করা কঠিন হতে পারে। সিইএস যদিও স্মার্ট হোম গ্যাজেটগুলোর মেলা বসিয়ে দেবে যা গুগল হোম, আইফোন-এর হোম অ্যাপ, স্যামসং ফোনে স্মার্ট স্মার্ট থিংস বা সবকটা থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
কিন্তু কথা এখানেই শেষ হচ্ছে না। অ্যাপল - যা দীর্ঘকাল ধরে আইফোন এবং কিছু আইপ্যাডের জন্য তার মালিকানাধীন লাইটনিং চার্জিং সিস্টেম ব্যবহার করেছে - বলেছে যে এটি অনেক ছোট ইলেকট্রনিক্সের জন্য ইউএসবি-সি চার্জিংয়ের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা মেনে চলবে। অ্যাপল পরের বছরের আইফোন আপগ্রেডের জন্য সময়মতো সুইচ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যার মানে ব্যবহারকারীরা এক চার্জারেই সব কটা গ্যাজেট ব্যবহার করতে সক্ষম হবেন।
স্ট্রিমিং পরিষেবায় নতুনত্বের ছোঁয়া: সিইএস অনেক জমকালো এবং কখনও কখনও হাস্যকর নতুন টেলিভিশন প্রদর্শনের জন্য সুপরিচিত। তবে গ্রাহক বা ব্যবহারকারী যে সিনেমা বা সিরিজ দেখবেন সেগুলো তো কোথাও না কোথাও থেকে আসবে। ব্যবহারকারীরা যে সব স্ট্রিমিং পরিষেবার গ্রাহক, ২০২৩ সালে সেগুলোতে নতুনত্বের ছোঁয়া লাগতে পারে। সিএনএন প্লাস এবং আসন্ন এইচবিও ম্যাক্স/ডিসকভারি প্লাস ম্যাশ-আপ সহ স্ট্রিমিং মিডিয়ার বয়স কয়েক বছর। অ্যাকসেঞ্চারের ইয়ালোভিটজ বলেছেন, গ্রাহকরা এবার ব্যবসায়িক মডেল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবেন। এর অর্থ হতে পারে গ্রাহকের পছন্দের স্ট্রিমিং সাবস্ক্রিপশনের কম মাসিক ফি বা পছন্দের শোগুলি বদলে যেতে পারে (অ্যাকসেঞ্চারের গবেষণা অনুসারে)। যাই হোক, অনেক গ্রাহকই চান, তাঁদের সমস্ত বিনোদনের জন্য একটি ওয়ান স্টপ শপ। ২০২৩ সালে সেই আশা পূরণ হতে পারে। ইয়ালোভিটজ যোগ করেছেন, ‘আপনি এবছর বিজয়ী এবং পরাজিতদের রূপকথা দেখতে পাবেন’। যদি তিনি কোনও সংস্থার নাম নেননি।
সাইবার নিরাপত্তাতে বাড়তি নজর: চটকদার গ্যাজেটের জন্য পরিচিত কোনও শো-তে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে যে খুব বেশি কিছু থাকবে না সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এমন একটা বিশ্বে যেখানে গ্রাহকরা ক্রমবর্ধমান সাইবার ডিজিটাল অপরাধের সম্মুখীন হচ্ছেন, সেখানে কোম্পানিগুলোর উপরেও যে এটা প্রভাব ফেলছে সেটাও অনসবীকার্য। ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত যে কোনও কিছু – হোম সিকিউরিটি ক্যামেরা, ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং, ট্রেন সিস্টেম – সাইবার আক্রমণের পথ খুলে দেয়। আইডেন্টিফাই থেফট রিসোর্স সেন্টারের কর্মীরা মনে করছেন, নতুন বছরে সাইবার জালিয়াতের ঘটনা আরও বেশি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক জাল অ্যাকাউন্টের হদিশও পাওয়া যাবে। এই বছর তাই সারা বিশ্বের শীর্ষ গ্যাজেট কোম্পানিগুলি সাইবার নিরাপত্তার দিকটিও খতিয়ে দেখবে। আগ্রহী প্রযুক্তিবিদদের মনে করিয়ে দেবে, সাইবার নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো এখনও সামনে রয়েছে। এবং এই নিয়ে বহু কাজ বাকি। নতুন বছরে সাইবার সিকিউরিটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। এই নিয়ে বড় কোম্পানিগুলো কী করে সেটাই এখন দেখার।
বিশ্ব জেনারেটিভ এআই-এর সঙ্গে লড়াই করছে: ম্যাজিক অবতার তৈরির জন্য ‘লেন্সা’ নামের কোনও কোম্পানিকে টাকা দিয়েছেন? কিংবা চ্যাটজিপিটি-র সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলেছেন? যদি তাই হয়, ভাল। গ্রাহক আসলে আর্টিফিসিয়াল ইনটিলিজেন্সের সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছেন। আসলে জেনারেটিভ এআই টুলস-এর সঙ্গে যে কেউ কথা বলে সময় কাটাতে পারে। এই বছরে এরকম আরও টুল আত্মপ্রকাশ করতে পারে। ডিসেম্বরের শুরুতে চ্যাটজিপিটি কোম্পানির পিছনে থাকা ওপেন এআই-তে মুষ্টিমেয় কিছু এআই কেন্দ্রিক কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। এবং "পণ্য ও শিল্পের পুনঃকল্পনা" করার জন্য একটি ইনকিউবেটর প্রোগ্রামের মাধ্যমে আরও বেশি করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে, এআই ইমেজ জেনারেটর যেমন মিডজার্নি এবং স্টেবল ডিফিউশন প্রতিটি আপডেটের সঙ্গে আরও পরিশীলিত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ধরণের সরঞ্জামগুলিকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ? ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধীরে ধীরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইছে। এআই কীভাবে ভাল কাজে লাগানো যায়? আবার এইআই-এর খারাপ দিকগুলো কী কী? সেটা জানা এবং বোঝার চেষ্টাও হচ্ছে। ২০২২ সালে এআই-এর উত্থানে এটা স্পষ্ট যে এগুলো যথেষ্ট সৃজনশীল। ২০২৩ সালে এআই সম্মিলিতভাবে কতদূর যেতে পারে তার পরীক্ষা হয়ে যাবে।
কোম্পানি জোর দিয়ে বলবে রোবট প্রয়োজন: বাড়ির কাজ, সন্তানদের বিনোদন, লনের ঘাস কাটা, খাবার বিতরণ – সব কিছুর জন্য একটা করে রোবট আছে। কোম্পানিগুলো বোঝাবে, এগুলোকে নির্দিষ্ট কাজ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আপনার খুব দরকার। অবশ্যই বাড়ির পাশের দোকানে রোবট কিনতে পাওয়া যাবে না। ২০২৩ সালে গৃহস্থালীর কাজের জন্য রোবট চলে আসবে। এটা নিশ্চিত। সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রির জন্য ইতিমধ্যেই অনেক কোম্পানি রোবট তৈরি করতে শুরু করেছে। রোবোটিক্স বিশেষজ্ঞরা গত বছর বলেছিলেন, ‘সামাজিক’ রোবটের পরিশীলিত জাত খুব শীঘ্রই চলে আসবে। তারা বাড়িতেই থাকবে, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলবে, গৃহস্থালীর টুকটাক কাজ করবে, রান্নাঘরেও হাত লাগাবে। সোজা কথায়, পরিচারিকার কাজ করবে রোবট। মানুষ এটার সঙ্গেই মিশে যাবে। একটা সময় রোবটই হয়ে উঠবে নিত্যদিনের সঙ্গী। সোজা কথায়, জীবনকে স্পর্শ করবে মেশিন। এটাই ভবিতব্য। কিন্তু কত দ্রুত সেটা হয়, তাই দেখার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৩-ই সেই বছর, রোবট আর মানুষের মেলবন্ধন হতে চলেছে।