নতুন বছরের প্রাক্কালেও তার অন্যথা হবে না। ইতিমধ্যেই হিসেব কষা শুরু হয়ে গিয়েছে। কোথায় যাওয়া যায়, কত খরচ, সব পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ চলছে। বাঙালির সেই পরিশ্রম লাঘব করতেই এখানে দেওয়া হল কলকাতা থেকে কাছেপিঠে ভ্রমণের কয়েকটা মারকাটারি গন্তব্যের ঠিকানা। চোখ বুলিয়ে দেখে নিন, পছন্দ না হয়ে যায় না।
দিঘা:
বাঙালি বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবলে প্রথমেই যে নামটা মাথায় আসে, সেটা দিঘা। কোনদিন পুরনো হওয়ার নয় সমুদ্রের ওঠাপড়া। আর এখন তো পর্যটকদের আকর্ষণ করতে নতুন সাজে সেজে উঠেছে সৈকতনগরী। সমুদ্র, সুস্বাদু সামুদ্রিক খাবার এবং কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বের কারণেই দিঘা সবচেয়ে জনপ্রিয় উইকএন্ড গেটওয়ে। দু’চারটে দিন হাত পা মেলে বিশ্রাম, সমুদ্রের ঢেউ গোণা। ছোট বিরতির জন্য এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে! দিঘার সমুদ্র তো আছেই, সামুদ্রিক অ্যাকোরিয়াম রিসার্চ সেন্টারও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আর ধর্মকর্মে মতি থাকলে ঘুরে দেখা যায় চন্দনেশ্বরের ভগবান শিবের মন্দির। বিকেলের দিকে দিঘার বোর্ডওয়াকে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যাস্ত দেখা। অনন্য অভিজ্ঞতা। সমুদ্রের বাতাসে সমস্ত মন খারাপ উড়ে যাবে। দিঘা জুড়ে অজস্র ‘ভাতের হোটেল’ রয়েছে। সস্তায় ভাল মানের খাবার পাওয়া যায়। বড় হোটেলও রয়েছে। চাইলে সেখানেও সপরিবারে লাঞ্চ বা ডিনার সেরে নেওয়া যায়।
advertisement
যাওয়ার পথ— হাওড়া স্টেশন থেকে প্রতিদিন সকাল ০৬.৪০ মিনিটে তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস, ১১.১৫ মিনিটে দুরন্ত এক্সপ্রেস এবং বেলা ১৪.৪০ মিনিটে কান্ডারি এক্সপ্রেস ছাড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিঘা পৌঁছে দেবে। সড়ক পথে গাড়িতেও কলকাতা থেকে মাত্র ৪-৫ ঘণ্টায় দিঘা যাওয়া যায়। গড়িয়া, ধর্মতলা এবং হাওড়া থেকে বাসও ছাড়ে।
আরও পড়ুন: ফের বাড়ল রুপোর দাম, সোনার বাজারের ছবিটা কীরকম? জেনে নিন কেনাকাটার আগে!
সৈকতে আস্তানা— দিঘায় থাকার জন্য অজস্র হোটেল, গেস্ট হাউজ আছে। খুব বেশি খরচ করতে হবে তাও নয়। তবে এই সময় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে আগাম বুকিং করে যাওয়াই ভাল।
আরও পড়ুন: অনলাইন গেমিং-এর উপরও কি কর? জানুন GST কাউন্সিলের বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হল
মন্দারমণি:
বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আর প্রশস্ত তটভূমি। মন্দারমণির বৈশিষ্ট্য। ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত মন্দারমণিতেই রয়েছে। গাড়ি চালানো যায়। তবে এখানে এখনও বাণিজ্যিকীকরণের ছোঁয়া লাগেনি। ফলে দিঘার মতো ভিড় উপচে পড়ে না। নিরিবিলিতে কয়েকটা দিন ছুটি কাটাতে চাইলে মন্দারমণি তাই আদর্শ। সমুদ্র সৈকতে জেট স্কিইং, ব্যানানা বোট রাইড, বাঞ্জি ট্র্যাম্প লাইনিং এবং রাইডিং এটিভি বাইক উপভোগ করা যায়।
যাওয়ার পথ— কাঁথি স্টেশনে নেমে গাড়ি ভাড়া করে মন্দারমণি পৌঁছতে হবে। এখানে ঘোরার জন্য গাড়িই একমাত্র বিকল্প। কলকাতা থেকে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। স্টেট ট্রান্সপোর্ট বাসেও আসা যায়। ১৩০ টাকা ভাড়া। প্রতিদিন বেশ কয়েকটা ডিলাক্স কোচও চলে, ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
সৈকতে আস্তানা— মন্দারমণিতে বেশ কিছু হোটেল এবং রিসর্ট আছে। সস্তায় থাকা, খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। পরিষেবাও ভাল। তবে এই সময় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে আগাম বুকিং না করলে পস্তাতে হবে।
বোলপুর:
বাঙালির প্রাণের শান্তিনিকেতন। কবিগুরুর বোলপুর। শান্ত, নিরিবিলি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র— বিশ্ব ভারতীর সঙ্গমক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের কারণেই বোলপুরে সারা বিশ্বের পর্যটক, শিল্প-উৎসাহী, ছাত্র এবং কৌতূহলী মানুষ আসেন। ঘুরে দেখেন উপাসনাস্থল, শ্যামলী বাড়ি, কলাভবন। বোগেনভেলিয়া আচ্ছাদিত ভবনগুলি মনে করিয়ে দেয় ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। মূলত বিশ্বভারতী এবং রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত স্থান এবং বাড়িগুলির টানেই এখানে ছুটে আসেন মানুষ। রয়েছে কঙ্কালিতলা সতীপীঠ। বহু মানুষ পুজো দিতেও আসেন।
যাওয়ার পথ— কলকাতা থেকে ট্রেনে বোলপুর ২ থেকে ৩ ঘণ্টার পথ। সকাল ১০.০৫ মিনিটে ছাড়ে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে সোজা বোলপুর। সড়কপথেও যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে এনএইচ ২ ধরলে ৩ ঘণ্টায় কবিগুরুর নিজের দেশে।
শান্তির নীড়— শান্তিনিকেতনে থাকার জন্য প্রচুর হোটেল এবং লজ রয়েছে। ভাড়াও কম। তবে বছর শেষে কিংবা পৌষ মেলার সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়। এই সময়ে যাবার পরিকল্পনা থাকলে আগাম বুকিং করাই ভাল।
দার্জিলিং:
কলকাতায় গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য পাহাড়ের কোলে এই শহর তৈরি করেছিলেন ইংরেজরা। বর্তমানে সেটাই বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় ছুটি কাটাবার জায়গা। দার্জিলিং বিখ্যাত চায়ের জন্য। অজস্র চা বাগান রয়েছে। ঘুরে দেখা যায়। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এই শহরের আরেকটি আকর্ষণীয় জায়গা হল, ম্যাল। বিকেলের দিকে সমস্ত পর্যটকরা জড়ো হন এখানেই। অ্যাডভেঞ্চার্স স্পোর্টসে আগ্রহ থাকলে পোয়া বারো। ট্রেকিং, পর্বত আরোহণ এবং মাউন্টেন বাইকিংয়ের মজা নেওয়া যায় পুরোদমে। আর আছে টয় ট্রেন। অনন্য অভিজ্ঞতা। আরাধনা থেকে শুরু করে পরিনীতা, বরফি-র মতো একাধিক জনপ্রিয় বলিউড সিনেমার শুটিং হয়েছে এখানে। দার্জিলিংয়ে এলে ‘হিমালয়ান জু’-তেও ঢুঁ মারতে হয়। রেড পান্ডাদের কার্যকলাপ মুগ্ধ করবে। আর হ্যাঁ, এখানে অজস্র বৌদ্ধ মঠ রয়েছে। শান্তিতে সময় কাটানোর জন্য এ গুলো আদর্শ।
যাওয়ার পথ— কলকাতা থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে দার্জিলিং। এটাই রুট। কলকাতা-সহ সমস্ত বড় শহরের সঙ্গে নিউ জলপাইগুড়ির যোগাযোগ রয়েছে। বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমেও যাওয়া যেতে পারে। তাই এখানে আসতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত নিয়মিত বাস সার্ভিস রয়েছে। খাড়া, বাঁকানো পথ। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ট্যাক্সি বা শেয়ারে জিপও ভাড়া করা যায়। ভাড়া নির্ভর করছে দর কষাকষির দক্ষতার উপর।
পাহাড়ি আস্তানা— দার্জিলিংয়ে অজস্র হোটেল, গেস্ট হাউজ, লজ রয়েছে। সুসজ্জিত। তবে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভাল।
সুন্দরবন:
জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ— সুন্দরবনের চিত্রকল্প এটাই। ভাগ্যে থাকলে চোখের সামনে আবির্ভূত হতে পারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবন মূলত ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। সঙ্গে নদী। পায়ে হেঁটে চলার পথ নেই। নদীর বুকেই ভ্রমণ। খাঁড়ি আর তস্য খাঁড়ি। এই ব-দ্বীপ বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক প্রজাতিই ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে ঘোরাঘুরি সময় গাইডের সঙ্গে থাকাই উচিৎ। গাড়ি থেকে একা বেরনোর কথা যেন স্বপ্নেও মাথায় না আসে।
যাওয়ার পথ— ক্যানিং সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের নিকটতম রেলপথ। কলকাতা থেকে ক্যানিংয়ের দূরত্ব ৪৫ কিমি। গোদখালি বন্দর থেকে ২৯ কিমি। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ক্যানিং পৌঁছতে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় লাগে। এটাই সুন্দরবন যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং কার্যকর উপায়।
জঙ্গলের আস্তানা— সুন্দরবনে একাধিক হোটেল এবং রিসর্ট আছে। যারা জঙ্গল সাফারি করতে চান তাঁরা আগে থেকে বুকিং করে আসতে হবে।
গ্যাংটক:
পাহাড়ের কোলে গ্যাংটক। ভিন রাজ্যের মনোরম জলবায়ু এবং অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। অজস্র বৌদ্ধ মঠ রয়েছে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় এনচে মঠ। গ্যাংটককে পর্যটকরা ‘পাহাড়ি স্বর্গ’ বলে থাকেন। পাহাড়ি মোমো, থুকপা তো আছেই, সুস্বাদু চিনা খাবার উপভোগ করতে চাইলেও গ্যাংটকের তুলনা নেই।
যাওয়ার পথ— পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্যাংটকের সঙ্গে সরাসরি সংযোগকারী ব্রডগেজ লিঙ্কের কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমানে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে সড়ক পথে গ্যাংটকে যেতে হয়। দূরত্ব ১২৪ কিলোমিটার। তবে কলকাতা থেকে সড়কপথেও যাওয়া যায়।
সিকিমি আস্তানা— গ্যাংটকে পর্যটকদের থাকার জন্য একাধিক সুসজ্জিত হোটেল ও রিসর্ট রয়েছে। বছরের এই সময় খুব ভিড় হয়। তাই আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভাল।
পুরী:
পুরী ভারতের অন্যতম তীর্থস্থান। জগন্নাথদেবের মন্দিরের জন্যই এর খ্যাতি। তবে প্রাচীন মন্দিরের কোনও খামতি নেই। বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত পুরীর সুস্বাদু সামুদ্রিক খাবার এবং ওড়িশার অনন্য দেশীয় কারুশিল্পের টানেও হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসেন। জুন-জুলাই মাসে পালিত হয় রথযাত্রা। সেই সময় পুরীতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না।
যাওয়ার পথ— কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে পুরী যাওয়া যায়। পুরী স্টেশনও শহরের কেন্দ্রস্থল এবং সমস্ত হোটেলের কাছাকাছি। পুরী আসতে চাইলে ট্রেনই ভাল। সস্তা এবং সুবিধাজনক। তবে চাইলে সড়কপথে গাড়িতেও আসা যায়।
নীলাচলের আস্তানা— পুরী পর্যটকদের জনপ্রিয় গন্তব্য। তাই অজস্র ছোট বড় হোটেল, লজ, গেস্ট হাউজ রয়েছে। বাজেট অনুযায়ী ভাড়া করা যায়। তবে বছরের শেষ দিকে বা নতুন বছরের শুরুর সময় ভিড় হয় খুব। তাই আগাম বুকিং করে নেওয়াই ভাল।
