সদর দরজায় দাঁড়াতেই চোখ গেল ওপরের অলিন্দের দিকে ৷ গ্রীষ্মের দুপুরের প্রখর তাপে দু’হাট করে খোলা সদর দরজা যেন উষ্ণতম অভিনন্দন জানাচ্ছে অপরিচিত আমাকে ৷ আশপাশে কোনও হৃদস্পন্দনের আভাস পাওয়া গেল না, চারিদিক থমথমে ৷ ঢুকতেই উন্মুক্ত চাতাল ও তার চারপাশে উঁচু উঁচু থাম চোখে পড়ল ৷ সেই থামের আড়ালে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে সারিবদ্ধ ঘর, যেন কত দিনের স্তূপাকৃত অভিমানের জেরে অন্ধকারে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে ৷
উত্তর কলকাতার সরু এক গলির মধ্যে অবস্থিত এই নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ তিনতলা বাড়িটি, যেন গ্রীষ্মের গনগনে তাপে চাপা গলায় কাঁদে ৷ সে কান্না কারোর কানে আসে না ৷ বাড়িটির চাতালে প্রবেশ করতেই মনে হল অতীতে ফেলে আসা রঙিন উৎসব ও বনেদিয়ানার ছবি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল ৷ শঙ্খধ্বনি, উৎসব, বিয়ে-পার্বণে সুন্দরী রমণীদের লাল পেড়ে শাড়ি পরে আনাগোনা, আরামকেদারায় বসে রাশভারি গলায় গৃহকর্তার হুকুম জারি করা - সমস্ত কিছু ৷ কিন্তু নিমেষের মধ্যে সে দৃশ্য প্রখর তাপে মিলিয়ে গিয়ে সামনে পড়ে রইল একরাশ ধুলো আর ঝুলে ভরা বারান্দা ৷ ঝকঝকে,সাজানো আসবাব মুহূর্তের মধ্যে ভাঙাচোরা আরাম-কেদারা, ছেঁড়া পর্দা ও রঙচটা দেওয়ালে পরিণত হল ৷ চাতাল ছেড়ে বাঁদিকে ঘুরে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই সামনে এল চৌকাকৃতি রেলিং ঘেরা লম্বা বারান্দা ৷ বারান্দার পাশে জীর্ণ,জংধরা তালায় বন্দি কিছু ঘর ৷ আসবাব আর দামি শো-পিসগুলো আজ পরিত্যক্ত ৷ অবহেলিত অবস্থায় এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ৷ যখন রাজা ছিল তাদের কদর ছিল, এখন রাজা নেই তাদের কদরও নেই ৷ এই সকল দামী আসবাব যাতে একসময় জমজমাট আড্ডা বসত বা যেসব জিনিসকে exibit করে আভিজাত্যের বড়াই করতেন জমিদাররা- তা এখন সব মৃতপ্রায় ৷ রাজকীয় সোফা, ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, আলমারি, মার্বেলের টেবিল, ফুলদানি সব এখন জঞ্জালের মতো স্তূপাকৃতি হয়ে পড়ে রয়েছে বারান্দায় ৷
বারান্দা ধরে সোজা চলেছি অথচ কারোর কোনও সাড়া নেই, দেখা নেই ৷ নিষ্প্রাণ, নিষ্পলকভাবে পুরো বাড়িটা যেন চেয়ে রয়েছে আমার দিকে, যেন কতদিন বাদে কোনও মানুষের পা পড়ল এই বাড়িতে ৷ বহুদিনের প্রতীক্ষার অবসান- কেউ তো পা রাখল এই নিঝুম পুরীতে ৷ বারান্দার তালাবন্ধ ঘরগুলো পেরিয়ে সোজা যেতেই বাধা পেলাম চৌকাঠে ৷ চৌকাঠ পেরিয়ে এগোতেই দেখি অন্দরমহলে ঢোকার সিঁড়ি ৷ অন্ধকার এই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেও বুক ছ্যাঁত করে উঠবে ৷ নীচেও পরপর তালাবন্ধ ঘর ৷ হাঁটতে হাঁটতে এত দূর এসেও কোনও প্রাণের সাড়া মিলল না ৷ রাস্তা শেষ হয়ে ধাক্কা খেলাম দেওয়ালে- একেবারে Dead End-এ ৷ বাঁদিকে ঘুরতেই সামনে দু-তিনটে ঘর, সব তালা বন্ধ ৷
সারা বাড়িটায় ঘুরতে ঘুরতে ভাবছিলাম এই বুঝি কারোর দেখা পেলাম, অন্তত কেউ একজন বেরিয়ে আমার অনধিকার প্রবেশের জবাব চাইবে ৷ কিন্তু না কেউই এল না ৷ আমিও ফিরে আসার জন্য আবার একতলায় নেমে এলাম ৷ হঠাৎ একটা খট করে শব্দ ৷ চমকে পিছনে ঘুরে তাকালাম ৷ কিন্তু কই, কেউ তো নেই! তারপর উপরে তাকিয়ে দেখলাম একটা পায়রা বাসা থেকে বেরিয়ে কড়িকাঠে বসেছে ৷ বুঝলাম শুধু এরাই আঁকড়ে রয়েছে এই বাড়িটাকে, আর কেউ নেই ৷ সদর দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম বাড়িটাকে ৷ রেলিং ও বারান্দার অর্ধেকটার ওপর চড়চড়ে রোদ পড়ে ঝলসে দিচ্ছে বাড়িটাকে ৷ আলো-আঁধারির মধ্যে ডুবে থাকা নিঝুম পুরীতে যেন কারোর চাপা কান্নার আওয়াজ পেলাম ৷ মনে হল মনের ভ্রম ৷ কিন্তু তারা বোধহয় রোজই কাঁদে ৷ কোনও প্রাণের স্পন্দন পেলে ককিয়ে ওঠে শিশুর মতো ৷ নিষ্প্রাণ নিথর দেহে উষ্ণ প্রাণের স্পর্শের জন্য আবার শুরু হল তাদের প্রতীক্ষা ৷