বই পাড়ার নববর্ষ: বিভেদ ভুলে মেতে ওঠার দিন

Last Updated:

মনে রাখতে হবে দিনটা পয়লা বৈশাখ। আর পাড়াটা কলেজ স্ট্রিট। গলি তস্য গলিতেও চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি, ঝাঁ চকচকে পাবলিসার্সের ঘরে ধূপ-ধুনো সহযোগে ইতিউতি মঙ্গলঘট, কলাগাছ, আমের পল্লব।

#কলকাতা: মনে রাখতে হবে দিনটা পয়লা বৈশাখ। আর পাড়াটা কলেজ স্ট্রিট। গলি তস্য গলিতেও চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি, ঝাঁ চকচকে পাবলিসার্সের ঘরে ধূপ-ধুনো সহযোগে ইতিউতি মঙ্গলঘট, কলাগাছ, আমের পল্লব। বইয়ের গন্ধ ছাপিয়ে উঠছে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবির গন্ধ, হালখাতা ৷ সিঁদুরের টিপে তখন নববর্ষের বোধন।
বই পাড়ায় পয়লা বৈশাখটা খানিকটা এক দিনের দুর্গাপুজো। আগের দিন বেশি রাত পর্যন্ত চলে প্রস্তুতি পর্ব। ওই একটা দিনই বইয়ের পাহাড় থেকে উঁকি দেয় আসল ঘরবাড়ির আসল চেহারাটা। ডাঁই করা বই থেকে একটু হলেও মাথা তুলে ওই একদিনের জন্য উঠে দাঁড়ায় দোকানের শ্রী। খোঁজ না রাখা একাধিক বইয়ের উপর থেকে বছরের এই একটা দিনে সরে যায় ধুলোর আস্তরণ। সিঁদুরের টিপ, হালখাতা, মিষ্টির বাক্স, নোনতার প্যাকেট সবটা মিলিয়ে বই পাড়া সে দিন বড্ড অন্য রকম। নাহ! তবে সে অচেনা নয়। গোটা বছর ধরে এই পাড়ার সঙ্গে ভালবেসে জড়িয়ে থাকা লোকগুলো এই দিনটার অপেক্ষাতে আজও দিন গোনে।
advertisement
এটা ঠিক, আগের জৌলুস ফিকে হয়েছে অনেকটাই। সে রাজাও নেই, নেই তার রাজত্বও। তবু আজও থাকার মধ্যে আছে সেই একই রকম প্রাণের স্পন্দনটা। কালের নিয়মে পুরনোরা চলে গিয়েছেন, সেই ফাঁক পূর্ণ করেছেন নতুনরা। হয়তো অন্য রকম ভাবে, অন্য ধাঁচে, অন্য নিয়মে। হয়তো জৌলুস কমে আধুনিকতা জায়গা করেছে, হালখাতাকে পাশ কাটিয়ে কম্পিউটারের ইঁদুরের মাথায় পড়ছে সিঁদুরের ফোঁটা। আমপোড়া সরবতকে তুড়ি মেরে হটিয়ে এসে গিয়েছে সফ্ট ড্রিঙ্কস। তবু বইপাড়া আছে বইপাড়াতেই। অনেকটা বুদ্ধদেব বসুর কথাটার মতো, ‘‘কলেজ স্ট্রিটে এখনও পাউরুটি রংয়ের বাড়িগুলো একই রকম আছে।’’ খাঁটি সত্যি!
advertisement
advertisement
হালখাতার পুজো দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর ৷ হালখাতার পুজো দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর ৷
নববর্ষের সকাল মানে এখনও বইপাড়ায় সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি বা পাজামা-পাঞ্জাবির ভিড়। তারপর হালখাতা বগলে সোজা কালীঘাট মন্দির। সেখানে পুজোআচ্চা শেষ হলে দোকানে ফিরে আসা। আগে কিন্তু প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে নতুন বই প্রকাশিত হত। বইমেলার কনসেপ্ট তখনও আমদানি হয়নি ৷ শারদীয়া বা পুজো সংখ্যার মতো পয়লা বৈশাখে কোন ঘর থেকে কী বই বেরচ্ছে তা নিয়ে প্রচারও চলত। ফলে সকলে তা জেনে যেতেন। আগেকার মতো অতো বেশি সংখ্যায় না হলেও এখনও বেশ কিছু প্রকাশক নতুন বই প্রকাশ করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমতে থাকে কলেজ স্ট্রিটের অলি-গলি। কে নেই সেখানে- প্রকাশক থেকে লেখক, কবি থেকে সাহিত্যক, মফস্বলের ছোট দোকানি থেকে বড় দোকানের মালিক, প্রুফ রিডার, বাইন্ডার, আর অবশ্যই পাঠক ৷ যেন এক অপার মিলনক্ষেত্র। কারও নতুন বই প্রকাশ পেয়েছে, কেউ নতুন বই কিনবেন, কেউ বা স্রেফ আড্ডা দেবেন। ছোট থেকে মাঝারি থেকে বড়, নানা মাপের, নানা ক্ষেত্রের, নানা ধরণের সক্কলে এসে হাজির। শুধু মিল তাঁদের একটাই, ‘পুস্তক প্রেম’।
advertisement
‘মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স’-এর সম্পাদক সবিতেন্দ্রনাথ রায়(ভানুবাবু) এক সাক্ষাৎকারে পুরনোদিনের পয়লা বৈশাখের স্মৃতিচারণা করে ভারি সুন্দর একটি গল্প বলেছিলেন। একবার নাকি পয়লা বৈশাখের সকালে দোকান খুলে হালখাতা নিয়ে কালীঘাটে যাওয়ার সময় তিনি দেখেন কিছু লোক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করাতে তাঁরা উত্তর দিল, ‘বইটা যদি না পাই তাই দাঁড়িয়ে আছি।’ সে বছর মা সরদার উপর একটি বই প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ৷ ১০% ছাড়ও ছিল। কালীঘাট থেকে ফিরে এসে তিনি দেখেন লাইন চলে গিয়েছে সংস্কৃত কলেজ অবধি। তারপর শুরু হল বই দেওয়া। সে এক হৈ হৈ কাণ্ড। শেষে ভিড় সামলানোর জন্য থানায় ফোন করতে হয়েছিল। এই মিত্র ও ঘোষেই ছিল ‘খেয়াল খুশির খাতা’। নববর্ষের দিন সেটা খুলে দেওয়া হত। ধীরে ধীরে শত শত গুণীজনের লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে সেই খাতাটি। মিত্র ও ঘোষ মানেই কিন্তু নববর্ষের মেনুতে মনোহরা থাকতেই হবে। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা নোনতা খাবার। একটা সময় প্যারামাউন্ট থেকে সরবত আসত। এখন সেখানে নরম পানীয়।
advertisement
‘আনন্দ’ পাবলিশার্সে অবশ্য মেনুতে অবশ্যই থাকত ডাব। কয়েক হাজার ডাব কেনা হত। সঙ্গে কাজু বাদাম, মিষ্টি, নোনতা। পানও দেওয়া হত। কেউ কেউ জর্দা চাইতেন। সে ব্যবস্থাও রেডি। এখন দৃশ্যটা একটু আলাদা। টেবলি সাজানো থাকে চপ, কাটলেট, সন্দেশ, কাজু বাদাম। বেরায়াদের হাতে হাতে ঘোরে চা, কফি, নরম পানীয়।
নববর্ষের দিন পাবলিশার্সের তরফে শুধু পেটপুজো নয়, লেখকদের বকেয়া চেক দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। আর ছিল প্রচুর প্রচুর আড্ডা। সকলে আড্ডার মুডে আর খুশির মেজাজে থাকলেও দোকানের কর্মচারী আর মালিকদের কিন্তু সে দিন অতিরিক্ত খাটুনির দিন। ওই দিন কারও ছুটি নেই। তবে দিনটা এতটাই স্পেশাল যে কাজের মধ্যেও এক অনাবিল আনন্দ সবার মনকে ঘিরে রাখে। তবে পুরনো লেখকরা আজও দুখ করেন অতীতের সেই নিখাদ আনন্দের দিনগুলো আর নেই বলে।
advertisement
তবে নববর্ষের স্মৃতির কথা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তা থেকে সে যুগের নববর্ষের আন্তরিকতা সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করা যায়। ‘‘এক নববর্ষের দিনে সমরেশদার (বসু) সঙ্গে দেখা। লেখালেখি নিয়ে কথা হতে সমরেশদা বললেন, একটি বিষয় নিয়ে উনি চিন্তা করছেন কিন্তু বিষয়টি কিছুতেই লিখে উঠতে পারছেন না। উনি চান আমি যেন বিষয়টি নিয়ে উপন্যাস লিখি। শুনে আমি তো অবাক! তাঁর বিষয় আমি লিখব! প্রথমে রাজি না হলেও পরে সমরেশদার কথা আমাকে মেনে নিতেই হল। রাজা অশোকের পুত্র কুণাল ও তাঁর রক্ষিতা তিষ্যরক্ষিতাকে নিয়ে লিখে ফেলি ‘স্মরণাগত’। বইটি সমরেশদার নামে উৎসর্গ করেছিলাম।। এই আন্তরিকতাটা তখন ছিল। যা আজকাল নেই। এখন নববর্ষে কলেজ স্ট্রিট যেতে আর ইচ্ছে করে না। এখন সকলে কীরকম যেন এক একটা দ্বীপের মতো হয়ে গিয়েছে!’’
view comments
বাংলা খবর/ খবর/দেশ/
বই পাড়ার নববর্ষ: বিভেদ ভুলে মেতে ওঠার দিন
Next Article
advertisement
Rhino rescue: বিপর্যয়ের সময় ভেসে গিয়েছিল তারা, অবশেষে ঘরে ফিরল ১০ গন্ডার! সফল 'অপারেশন রাইনো'
বিপর্যয়ের সময় ভেসে গিয়েছিল তারা, অবশেষে ঘরে ফিরল ১০ গন্ডার! সফল 'অপারেশন রাইনো'
  • ১৩ দিনের অপারেশন রাইনোতে ১০টি গন্ডার উদ্ধার করেছেন বনকর্মীরা

  • বিপর্যয়ের সময় জলদাপাড়া থেকে ভেসে গিয়েছিল বেশ কয়েকটি গন্ডার

  • অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বনকর্মীরা গন্ডারগুলোকে জঙ্গলে ফেরাতে সক্ষম হন

VIEW MORE
advertisement
advertisement