শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি, অপুর পরিবারের কোনও পুরুষের হাতের আঙুলের কোনও ছাপ পড়ে না। তবে আগের প্রজন্ম এই সমস্যা সরাসরি না বুঝলেও আপাতত জীবন দুর্বিষহ, কারণ জীবনই যে আজ বায়োমেট্রিক। পদে পদে সমস্যায় পড়েন অপু।
অবশ্য অপু নন, সমস্যাটা ছিল অপুর দাদুরও। কিন্তু জীবনের বাঁক ছিল অন্য, কৃষিজীবী মানুষ ছিলেন তিনি। কোনও সমস্য়ায় ভুগতে হয়নি তাঁকে। প্রথম সমস্যাটার মুখোমুখি হন অপুর বাবা, অমল সরকার, অপু সেদিন নেহাতই কিশোর। বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক হয় সে বছরই। সেই সঙ্গে চালু হয় আঙুলছাপ তালিকাভুক্ত করা। অপুর বাবার পরিচয়পত্র তৈরি করার সময় সরকারি আধিকারিকরা দেখেন, তাঁর আঙুল ছাপ পড়ছে না। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও কোনও কাজের কাজ না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার তাঁকে পরিচয়পত্র দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু সেই কার্ডে লেখা ছিল নো ফিঙ্গারপিন্ট।
এখানেই শেষ নয়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাসপোর্ট জোগাড় করেছিলেন অপুর বাবা। যদিও কোনও দিন সাহস করেননি দেশের বাইরে যাওয়ার। বেড়ানোর সাধ অপুরও। কিন্তু তাঁকে পাক খেতে হয় রাজশাহীতেই,পাছে বিদেশ বিঁভুইয়ে বিমানবন্দরে কৈফয়ত দিতে হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স করাতে গিয়ে অপুর বাবা অমলবাবু বিপাকে পড়েন। টাকা গিয়েও গাড়ির লাইসেন্স পাননি তিনি, কারণ বায়োমেট্রিকে আঙুলছাপ মেলে না। ঘোরেন লাইসেন্স ফি জমা করার কাগজ নিয়ে। তারপরেও পদে পদে সমস্যায় পড়তে হয়, অনেক সময়েই অসংবেদনশীল পুলিশ হেনস্থা করে, টাকা নেয় জুলুম করে।
এখন নিজের নামে বৈধ সিমকার্ডও নিতে পারেন না অপু ওই এক কারণে। ভাই অনুরও সমস্যা এক। অবশ্য অপু-অনুর দিদিমা সুমিতা সরকার অন্য বংশের হওয়ায় তাঁর এই ধরনের কোনও সমস্যা নেই।
কিন্তু কেন এই সমস্যা অপুদের পরিবারের? চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তাঁরা অ্যাডারমাটোগ্লিফিয়ার শিকার। এটি জিনগত অসুখ। কনজেনিয়াল পালমোপ্লান্টার কেরাটোডার্মা এই অসুখের চেহারা ধারণ করেছে। এই রোগে আক্রান্তদের হাত ও পায়ের তালু শুষ্ক হয়, হাত, পায়ের তালুতে কোনও রেখাই থাকে না।
২০০৭ সালে এক সুইস ভদ্রমহিলা এই মার্কিন বিমানবন্দরে বায়োমেট্রিক ছাপ দিতে পারছিলেন না, তখনই এই রোগটি গোটা বিশ্বের সামনে আসে। দেখা যায় ওই মহিলার পরিবারের অনেকেই ওই রোগে আক্রান্ত। এই রোগের তাৎক্ষণিক নাম দেওয়া হয় ইমিগ্রেশনান ডিলে ডিজিজ।
আর এই অসুখই প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে অমলবাবুদের। অপুর দিদিমা সুমিতাদেবী এ বাড়িতে এসেছিলেন সাত আট বছর বয়সে। তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে আজ, কিন্তু যখন এসেছিলেন এই সরকার বাড়িতে, বয়স এত কম ছিল তিনি বিষয়টিকে প্রথমে বোঝেননি। কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার ফলেই স্বামীর চামড়ার রোগ হয়েছে এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। শুধু অমলবাবুর পরিবার কেন, এই সেদিন পর্যন্ত দুই বাংলার কারও এই বিষয় সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না।
তবে একঘরে হতে হয়নি। অমলবাবুই আমাদের জোর গলায় বলছিলেন, "কোনও দিন কেউ এর কারণে দূরে ঠেলে দেয়নি, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ৩০ বছর আগে যেমন ছিল আজও তেমন।" অমলবাবুদের রোগটা বিরলের মধ্যে বিরলতম, নিয়মের গেরো তাই আজ তাদের কাছে অভিশাপ, তবে আত্মীয়রা, প্রতিবেশীরা প্রতি মুহূর্তে বার্তা দিয়ে যান আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি, তাই জীবনযুদ্ধে আজও হারেননি অমলবাবু। চোখে জল, মুখে হাসি অপুর...
কৃতজ্ঞতা-ফেরদৌস সিদ্দিকী।
First Published :December 30, 2020 9:40 PM IST