হোম /খবর /বিদেশ /
মধ্যপ্রাচ্যে ছোট্ট দেশ বাহরিনে দুর্গাপুজোর সূচনা কীভাবে?জানাচ্ছেন প্রবাসী বাঙালি

Bahrain Durga Puja 2021 : মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ বাহরিন-এর দুর্গোৎসব! প্রবাসে থাকা বাঙালি এখানে কীভাবে পুজো শুরু করেছিলেন

Bahrain Durga Puja 2021 : এবছর বঙ্গীয়সমাজ বাহরিনের দুর্গা পুজোর ৩২ বছর বর্ষপুর্তি। কী ভাবে শুরু হয়েছিল? বাহরিনে প্রথম মূর্তি পুজো কবে এবং কীভাবে শুরু হয়? এইরকম অনেক জানা-অজানা তথ্য নিয়ে জানালেন বাহরিনেরই বাঙালি বাসিন্দা নন্দিতা চ‌ট্টোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন...
  • Last Updated :
  • Share this:

#মানামা: এবছর বঙ্গীয়সমাজ বাহরিনের দুর্গা পুজোর ৩২ বছর বর্ষপুর্তি। কী পরিবেশে আর ঠিক কেমন করে হয় এই পুজো? কী ভাবে শুরু হয়েছিল? বাহরিনে প্রথম মূর্তি পুজো কবে এবং কীভাবে শুরু হয়? এইরকম অনেক জানা-অজানা তথ্য নিয়ে জানালেন বাহরিনেরই বাঙালি বাসিন্দা নন্দিতা চ‌ট্টোপাধ্যায়

বাহরিনের পুজোর কথা বলতে গেলে প্রথমে বাহরিন দেশটার কথা বলতে হয়। বাহরিন সমুদ্রে ঘেরা মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট একটা দেশ। মধ্যপ্রাচ্য বলতেই আজকাল অনেকসময় চোখে ভেসে ওঠে অশান্ত কোনও দেশের ছবি। কিন্তু বাহরিনের পরিবেশটা ঠিক তার উল্টো। আমরা যারা কলকাতার মিছিল, মহামিছিল, পথ-অবরোধ, ধর্মঘট দেখে বড় হয়েছি, প্রথম আসার পর তাদের কাছে দেশটা ভারী অদ্ভূত লাগে। মনে হয়, এ কেমন দেশ যেখানে আজ-কাল-পরশুকে আলাদা করে চেনা যায় না। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের মতো ঘরছাড়া মানুষগুলির কাছে দেশটা সহজ ভাবে বেঁচে থাকার নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে।

ভারতীয়দের কাছে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা খুব পরিচিত এক শব্দ। কারণ আমরা সংবিধান-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তবে বাস্তবে তার কতটা প্রতিফলন ঘটে। সে প্রশ্ন আলাদা। বাহরিন নিজের পরমত বাপরধর্ম সহিষ্ণুতার ছবিটা সেভাবে তুলে ধরে না। কিন্তু আমরা যারা বাহরিনে থাকি তারা বুঝতে পারি এর পরমত সহিষ্ণুতাকে। ছোট্ট দেশ, কিন্তু পৃথিবীর বহু জনজাতির মানুষ এখানে থাকেন। প্রত্যেকেই নিজের নিজের

সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ পান। যেমন আমরা পাই দুর্গাপুজো করার সুযোগ।

আমাদের দুর্গাপুজোর ভাবনা শুরু হয় ১৯৮৫ সাল থেকে। সে বছর বিজয়া সমাবেশে একটি ছোট্ট মেয়ে দুর্গা সাজে। ১৯৮৮-তে কয়েকজন বাঙালি মিলে ভাবলো এখানে দুর্গা পুজো শুরু করলে কেমন হয়। তারপর ১৯৮৯-এ কিছু মানুষের সাহসে, কিছু মানুষের শঙ্কায় এই মুসলিম দেশে বাঙালির দুর্গাপূজা শুরু হয়। ১৯৮৯-৯০ সালে প্লাইউড-এ মায়ের কাটআউট বানানো হয়। ১৯৯৯-এ প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে দুর্গামূর্তি তৈরি হয়। বাহরিন-এরসেই প্রথম মুর্তিপূজা শুরু হয় বাঙালিদের হাত ধরে। পরবর্তীকালে অন্যান্য প্রদেশের ভারতীয়রা তা অনুসরণ করেন।

চার হাজার বছর পুরনো দিলমান (Dilmun) সভ্যতায় মৃৎশিল্প বিখ্যাত ছিল। নব্বই দশকের গোড়া থেকে বাহরিনের কুমোরদের শিখিয়ে নিয়ে, তাদের হাতে তৈরি হতে লাগলো মায়ের পুজোর প্রদীপ, ধুনুচি, সহস্রপ্রদীপ। ঘটল দুই প্রাচীন সভ্যতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। দেশভাগ, বিশ্বব্যাপী মন্দা, বেকারত্ব বাঙালির যৌথ পরিবারগুলোকে ভেঙে দিয়েছিল। আজ শতকরা ৯০ ভাগ বাঙালি যৌথ পরিবারের স্বাদ নেয় টিভি সিরিয়ালের মধ্যে দিয়ে। তবে আমরা কিছু ভাগ্যবান বাঙালি, যারা অন্যদেশে নিজেদের মতো করে একটা যৌথ পরিবার তৈরি করে নিয়েছি। এই পরিবার কোনও বাড়ি নয়, একটা ক্লাবকে ঘিরে তৈরি। তাই এর বারান্দার রোদ্দুরে মা-কাকিমারা গল্প করে না বা ছাদে আচার কিংবা বড়ি শুকোয় না। ছোট্ট সদস্যরা ঠাকুমাকে ঘিরে গল্প শোনে না। এই পরিবারের ছোটরা বড় হয় একলা ঘরের কোণে, কম্পিউটার বা স্মার্টফোনকে সঙ্গী করে।

আমাদের পরিবার আকার পায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে। তার মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান। স্কুল, কলেজ, অফিস ছুটি থাকুক বা না থাকুক, প্রতিদিনের তিথি ও যথাযথ নিয়ম মেনে হয় আমাদের পুজো। খুব সকালে পুজো হলে মেয়েরা রাত জেগে পুজোর আয়োজন করেন। আমদের পুজোয় আগে সাধারণত থিমের অতটা চল থাকতো না। চোখ ধাঁধানো প্যান্ডেলও থাকে না। থাকে না মাথা দোলানো কাশফুল কিংবা শিউলির গন্ধ।

আমাদের সদস্যরা নিজেদের সৌন্দর্য্যবোধ দিয়ে অনুষ্ঠান হলের পুজো মঞ্চ অপরূপভাবে সাজিয়ে নেন। গত কয়েক বছরে অবশ্য আমরা থিম-এরও সংযোজন করেছি। ২০১৮-এ পুজো মণ্ডপের থিম ছিল বাঙালি-বিবাহেরআচার অনুষ্ঠান। আর ২০১৯-এর থিম- গ্রাম বাংলা। শিল্পী যামিনী রায়ের মাতৃমুখের ছবি, শিশুদের সহজ-পাঠের ছবি, গ্রামবাংলার কুঁড়েঘর, তুলসীমঞ্চ, তালপাতার পাখা, ইত্যাদি নানান উপাদানে আমরা তৈরি করেছিলাম পল্লীবাংলার প্রতিচ্ছবি।

ষষ্ঠীর বোধন থেকে যখন আমাদের পুজো শুরু হয়, তখন যেন এক টুকরো কলকাতা আমাদের অনুষ্ঠান হলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ধুপ-ধুনোর ধোঁয়া, ঢাকের বাদ্দ্যি, কাঁসর-ঘন্টার শব্দে ফিরে আসে আসে আমাদের ফেলে আসা দিনগুলো। যে দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি আমরা তুলে ধরতে চাই আমাদের সন্তানদের কাছে, পরবর্তী প্রজেন্মের কাছে। আমাদের অনাড়ম্বর, ঘরোয়া পুজোয় জৌলুস আনে আমাদের মেয়েদের অসাধারন, অনবদ্য সাজসজ্জা। ছেলেরাও নিজেদের মতো করে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন। কিন্তু মেয়েদের উজ্জ্বল উপস্থিতি তাদের কিছুটা নিস্প্রভ করে দেয়।

পুজোর ষষ্ঠী থেকে দশমী প্রত্যেকটা দিন আমরা আলাদা আলাদা করে উপভোগ করি। ষষ্ঠীর বোধন, সপ্তমীর অধিবাস, কলা বউ স্নান, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজোর ১০৮ পদ্ম আর প্রদীপ, নবমীর ধুনুচি নাচ আর দশমীরসিঁদুর খেলা - পুজোর কয়েকটা দিন আমাদের মাতৃ-বন্দনায় মশগুল করে রাখে। যথাযথ নিয়ম, নিষ্ঠা, অপার ভক্তি আর প্রাণভরা ভালবাসা দিয়ে আমরা মাকে আবাহন করে বলি: রূপং দেহি জয়ং দেহি/ যশো দেহি দ্বিষো জহি।

দশমীর সিঁদুর খেলায় আমাদের প্রত্যেক নারী ব্যক্তিত্বে, সৌন্দর্যে অসামান্য হয়ে ওঠেন। এই একটা দিন আজকের পৃথিবীর 'লুক ইংয়' ভাবনাকে পিছনে রেখে প্রত্যেক নারী একজন মা এবং স্ত্রী হয়ে ওঠেন। মায়েরকাছে তাঁদের একমাত্র প্রার্থনা থাকে সারা বছর যেন তাঁদের স্বামী-সন্তানেরা ভালো থাকে। আমাদের পুজো শেষ হয় দশমীর সন্ধ্যার বাচ্চাদের অনুষ্ঠান,আনন্দমেলা, শুভেচ্ছা বিনিময়, কোলাকুলি আর ভূরিভোজে। এই প্রসঙ্গে বলতেই হচ্ছে, মায়ের সুস্বাদু ভোগ প্রসাদ আর প্রতিবেলার রকমারি খাবারের মেনুতে আমরা দেশের যে কোনও পুজোর সমকক্ষ হতে পারি।

প্রবাসে মানুষ খুঁজে বেড়ায় নিজের ভাষার মানুষকে। প্রবাসী মনে প্রশ্ন করে, "আমি কোথায় পাব তারে,আমার মনের মানুষ যে রে"। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তার উত্তর মেলে - "আমার প্রানের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকল খানে"। শুধু প্রবাসী মন নয়, মানুষের মনের এই অন্বেষণ এবং উপলব্ধির উপরেই দাঁড়িয়ে বাহরিনের বঙ্গীয় সমাজ পরিবার। এই উপলব্ধিই নতুন, পুরোনো সদস্যদের আসা-যাওয়ায় প্রবহমান আমাদের পরিবারের বাঁধনকে শক্ত করে রাখে।

ছবি ও লেখা: নন্দিতা চ‌ট্টোপাধ্যায়

Published by:Swaralipi Dasgupta
First published:

Tags: Durga Puja 2021, Durga-puja-international -2021