#কৃষ্ণনগর: এক যে ছিল দেশ, আর তার এক যে ছিল রাজা ৷ তাঁর আমলে পুরনো দেশটা বদলে গেল আমুল ৷ চতুর্দিকে রাজার নামে জয়জয়কার ৷ রাজার রাজত্ব সুখে শান্তিতে দিব্যি এগিয়ে চলে ৷
তিনি নদিয়ার কৃষ্ণনগরের রাজা ৷ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ৷ বারবারই তাঁর নাম খুঁজে পাব ইতিহাস বইয়ে ৷ এ দিকে তিনিই শুরু করেছিলেন কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো ৷ তার হাত ধরেই এই পুজো জনপ্রিয় হয় ৷ চন্দননগরের পুজো এর অনেক পরে শুরু ৷ এরপর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রিয়তা পেয়েছেন মা জগদ্ধাত্রী ৷
কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত বারোদোল মেলাও তাঁর হাত ধরেই শুরু ৷ এই বারোদোলের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে নববর্ষের সুপ্রাচীন ইতিহাসও ৷ নববর্ষ আজ যতই বাঙালি গন্ধ মাখা হোক না কেন, এর সূত্রপাত যদিও মহামতী আকবরের হাত ধরে ৷ সে গল্প আজ প্রায় সকলেরই জানা ৷ কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা তোলার জন্যই নববর্ষের জন্ম ৷ চৈত্র মাসে ফসল ওঠে ঘরে ৷ সেই ফসল বিক্রি করেই টাকা আসে ৷
সেই টাকা থেকে মহারাজের খাজনা চোকান কৃষকরা ৷ নতুন করে খাজনার হিসাব রাখার জন্যই এল নতুন ক্যালেন্ডার ৷ কিন্তু কী করে যেন মুঘল দরবার পার করে বাঙালির ধানের গোলায়, মঙ্গলঘট, আমের পল্লবের সঙ্গে আজ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গেল নববর্ষ ৷ সেই থেকে পয়লা বৈশাখ হয়ে গেল বাঙালির একান্ত নিজের উৎসব ৷ এই উৎসবকে আরও বেশ খানিকটা জনপ্রিয়তা দিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ৷
যদিও তিনি সিংহাসনে বসার অনেক আগে থেকেই এই রাজপরিবারে পয়লার পার্বণ পালিত হত মহাসমারোহে ৷ রং দোলের এক মাস পর শুক্ল পক্ষের একাদশী থেকে শুরু হয় বারোদোল ৷ আজও এই রেওয়াজ আছে ৷ এক মাস ধরে চলে এই বারোদোলের মেলা ৷ দিনে দিনে এই মেলার নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা রাজ্যে ৷ এই সময় বারো জায়গা থেকে কৃষ্ণ ঠাকুর আসেন রাজবাড়ির নাট মন্দিরে ৷ সঙ্গে পূজিত হন রাজবাড়ির কূল দেবতা বড় নারায়ণ আর ছোট নারায়ণও ৷ তিন দিন ধরে চলে পুজো ৷ প্রথমদিন ঠাকুরকে সাজানো হয় রাজবেশে ৷ পরের দিন ফুলবেশ, শেষ দিন রাখালবেশ ৷ এই তিন দিন জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় রাজবাড়ির নাট মন্দির ৷ সূক্ষ্ম পঙ্খের কারুকাজ করা সেই নাট মন্দির দেখলে আজও বিস্মৃত প্রায় কোনও এক ইতিহাসের সামনে মাথা নুয়ে আসে ৷ যদিও কালের নিয়মে অনেক কাজই হারিয়ে গিয়েছে আজ ৷
এ যুগের মতো সে যুগেও নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বারোদোলের মেলা ৷ তবে সেই সময় রমরমা ছিল আরও বেশি ৷ পয়লা বৈশাখের মোটামুটি ১৫ দিন আগে শুরু হয় আর থাকে নববর্ষের ১৫ দিন পর পর্যন্ত ৷ আগে পয়লা বৈশাখের দিন ভোর থেকে সানাই বেজে উঠত রাজবাড়ির নহবতখানায় ৷ কৃষ্ণচন্দ্র ওই দিন গো-বন্দনার সূচনা করেছিলেন ৷ সারা এলাকার মানুষই গরুকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করত ওই দিন ৷ জাতি-ধর্ম নির্বশেষে সকলে যোগ দিতেন এই অনুষ্ঠানে ৷ আজও কৃষ্ণনগরের গোপ সম্প্রদায়ের মানুষরা পয়লা বৈশাখের দিন মাটির উনুনে মাটির পাত্রে দুধে জ্বাল দেন ৷ দুধ উথলে উঠলে তা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় ৷
পয়লা বৈশাখের দিন রাজবাড়িতে থাকত ঢালাও ভূড়িভোজ ৷ সমস্ত প্রজাদের খাওয়ানো হত ৷ প্রজারা ওই দিন খাজনা শোধ করত রাজার কাছে ৷ রাজ্যের সমস্ত স্বর্ণকাররা তাঁদের হালখাতা বগলে ছুটতেন, রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে হালখাতা ছুঁইয়ে আনার জন্য ৷ রাজবাড়িকে শুভ মানতেন প্রজারা ৷ রাজবাড়ি থেকে ওই দিন কেউ অভুক্ত ফিরতেন না ৷
এর জন্য তিন দিন আগে থেকে রাজবাড়িতে বসত ভিয়েন, আসতেন দেশ-বিদেশের নামজাদা হালুইকররা, রাঁধুনী, ঠাকুর, বেয়ারা, খানসামায় গমগম করে উঠত রাজবাড়ির উঠোন ৷ সমানের বড় মাঠে সামিয়ানা টাঙিয়ে চলত রান্নাবান্না ৷ অন্যদিকে বসত মেলা ৷ বিকেলে একপ্রস্থ মিষ্টি আর ঠাণ্ডা সরবত খেয়ে শুরু হত কাব্য সম্মেলন ৷ রাতে বসত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর ৷
১৭২৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ৷ কিন্তু সংস্কৃতি মনস্কতায়, স্বকীয়তায়, সুশাসনে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন তিনি ৷ এ দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নাম ৷ আজও তাঁর তৈরি রাজবাড়ি, তাঁর সাম্রাজ্য, তাঁর হাতে শুরু হওয়া পুজো আধা-বিস্মৃতপ্রায় মহারাজার ঐতিহ্য নীরবে বহন করে নিয়ে চলেছে ৷
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Krishnagar, Poila Boisakh 2021