শুধুই মেয়েলি ব্রত নয়, ছেলেরাও পালন করতে পারে শিবরাত্রি

Last Updated:
#কলকাতা: বাংলার গ্রামে-শহরে ছড়ানো হাজার হাজার শিবমন্দির যেন ফাল্গুন মাসে জেগে ওঠে শিবরাত্রি উপলক্ষে। শহরের অলিতে গলিতে অজস্র শিবমন্দিরের অস্তিত্ব হঠাৎ টের পাওয়া যায় তারস্বরে বাজানো চটুল গানের দৌলতে। হবে না-ই বা কেন, সব ব্রতের মধ্যে শিবরাত্রিকেই তো শ্রেষ্ঠ ব্রত বলে ধরা হয়। এই ব্রত পালন করলে নাকি নারীর সব কামনা পূর্ণ হয়ে যায়— পতিকামনা, পুত্রকামনা, বৈধব্য খণ্ডন ও সাংসারিক মঙ্গল। মধ্যযুগের যে সমাজে এই ব্রতের প্রচলন হয়, সেখানে মেয়েদের— তা সে কুমারী সধবা বা বিধবা যাই হোক না কেন— পরিবারের বাইরে অন্য কিছু চাইবার মতো কোনও ফাঁকই রাখা হয়নি। আজ পরদা সরেছে, কিন্তু সংস্কার কাটেনি, কিংবা সংস্কার— আরও অনেক সংস্কারের মতোই— হয়ে উঠেছে নিছক বাৎসরিক উৎসব।
ব্রতকথা অনুযায়ী, শিবরাত্রি ব্রতের ব্যাখ্যা করেন মহাদেব স্বয়ং। পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, প্রভু, এমন এক সহজ ব্রত বলে দিন, যা সকলেই পালন করে পাপমুক্ত হতে পারে। মহাদেব বললেন, ‘ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে যে ভয়ানক অন্ধকার রাত্রি হয়, তা-ই শিবরাত্রি। শিবরাত্রিতে যে উপবাস করে, আমি তার উপর খুব সন্তুষ্ট হই।... শিবরাত্রিতে চার প্রহরে চারটি গঙ্গামাটির শিব গড়ে পূজা করবে।... ওই দিন রাত্রি জাগবে...’ পুজোর উপকরণ সরল, বেলপাতা আর গঙ্গাজলই যথেষ্ট। জটিল মন্ত্রতন্ত্র কিছু নেই, দীর্ঘ প্রস্তুতিরও প্রয়োজন নেই। সাধে কি আর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রত, সহজে পাপমুক্তি আর সপরিবার মঙ্গলের ব্যবস্থা!
advertisement
শুধু কি তাই? শিবরাত্রি মোটেই শুধু মেয়েদের পালনীয় ব্রত নয়। ছেলেরাও শিবরাত্রি করতে পারে। করেও। আসলে প্রথম শিবরাত্রি তো করেছিলেন এক জন পুরুষই! সে গল্পও শুনিয়েছেন শিব। বারাণসীর এক ব্যাধ— ধর্মকর্মের বালাই নেই, পশুহত্যাই তার জীবিকা। পাপের ভারা তাই কানায় কানায় পূর্ণ। সারা দিন শিকারের পর ক্লান্তিতে গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, সন্ধে হয়ে যাওয়ায় বাড়ি যেতে পারবে না ভেবে সে গাছের ডালেই রাতটা কাটিয়ে দেয়। গাছটা ছিল বেলগাছ, আর তলায় ছিল একটা শিবলিঙ্গ। ব্যাধের গায়ে লেগে একটা বেলপাতা শিশিরের জলের সঙ্গে মিশে শিবের মাথায় পড়ল। সেটা ছিল শিবরাত্রি, আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। পর দিন বাড়ি ফিরে স্নান করে সে দেখে, এক অতিথি উপস্থিত। তাঁকে খাইয়ে তার পরেই ব্যাধ নিজে খেয়েছিল। ফলে তার ব্রত পালন ঠিকমতই সম্পন্ন হল। ব্যাধ মারা যাওয়ার পর শিবদূত আর যমদূতদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষে শিবের দূতেরাই জয়ী হল, আর যমরাজও স্বীকার করলেন, শিবচতুর্দশী করলে তার উপর আর যমের অধিকার থাকবে না। মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধারের এটাই একমাত্র উপায়, পার্বতীকে জানালেন শিব।
advertisement
advertisement
22 প্রথম শিবরাত্রি তো করেছিলেন এক জন পুরুষই ৷ ছবি: দেবমাল্য দাস ৷
সত্যি, শিব তো আশুতোষ, খুব সহজেই তাঁর মন পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলায় তাঁর এত প্রভাব-প্রতিপত্তির উৎস কী? বাংলা এমনিতেই বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলের বাইরের দেশ ছিল। পালযুগের বাংলায় বৌদ্ধদের রমরমা, এমনকী বৌদ্ধ তন্ত্রেরও পীঠস্থান এই পূর্ব ভারত। তবে এরই মধ্যে পাল আমলের শেষ দিক থেকে সেন আমল জুড়ে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের জন্য রাজা এবং অভিজাতদের বিপুল পৃষ্ঠপোষণাও নজরে পড়ে। পরে সুলতানি শাসনের ধাক্কায় অনেক দিনের নিস্তব্ধতা। মধ্যযুগের শেষ পর্ব থেকে এক দিকে চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম, অন্য দিকে আধা-ব্রাহ্মণ্য আধা-লৌকিক শৈবধর্ম যে ভাবে ব্যাপ্ত হয় বাংলা জুড়ে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, এ জমি ‘অন্য’ মতবাদের জন্য কতটা উর্বর ছিল! অন্য সব দেবদেবীকে এ ব্যাপারে টেক্কা দিয়েছেন শিব। তিনি তো বৈদিক দেবতা নন, ঋগ্বেদে ‘রুদ্র’ ভয়ংকর দেবতা, কিন্তু শিবের কোনও উল্লেখ নেই, বরং সেখানে ‘লিঙ্গপূজক’ বিরোধী মনোভাবই নজরে পড়ে। ক্রমে শ্মশানবাসী শিব হিন্দু ধর্মের তিন প্রধানের অন্যতম হয়ে উঠলেন। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের দেবতা বলে সাধারণ ভাবে চিহ্নিত করা হলেও, শিবভক্তরা শিবকেই সব কিছুর স্রষ্টা ও সংহারকর্তা বলে মানেন।
advertisement
পৌরাণিক নানা কাহিনিতে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর থেকে শিবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা হয়েছে। সব থেকে পরিচিত বোধহয় সেই স্তম্ভরূপী শিবের গল্প, যেখানে হংসের রূপ নিয়ে ব্রহ্মা স্তম্ভের শীর্ষ আর বরাহের রূপ নিয়ে বিষ্ণু তার তলদেশ নির্ণয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, ব্রহ্মা আবার মিথ্যে করে বলেন, তিনি শীর্ষদেশ দেখতে পেয়েছেন, তাতে শিব অভিশাপ দেন— ভারতে আর ব্রহ্মার পূজা হবে না। শেষে ব্রহ্মা বিষ্ণু দুজনেই শিবকে স্রষ্টা হিসেবে মেনে নেন। শিবের লিঙ্গপূজা প্রচলনের গল্প আছে ‘কূর্মপুরাণ’-এ। দেবদারু বনে তপস্যারত মুনিঋষিরা ছদ্মবেশী শিব আর বিষ্ণুকে চিনতে পারেননি, নানা ঘটনার পর প্রকৃত রূপ দেখে তাঁর বন্দনা করেন এবং লিঙ্গপূজা প্রচলিত হয়। ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলে নিজের জায়গা করে নিতে ভূতপ্রেত নিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করতে হয়েছিল শিবকে, নাচতে হয়েছিল প্রলয়নাচন। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও শিবের মধ্যে সেই দ্বৈত সত্তাই থেকে গিয়েছে— এক দিকে তিনি শ্মশানের দেবতা, ভূতপ্রেত তাঁর অনুচর, কাপালিকরা তাঁর সাধক; অন্য দিকে তিনি কৈলাসে পার্বতী কার্তিক গণেশকে নিয়ে ঘোর সংসারী। আর এই সংসারী, সহজে সন্তুষ্ট, আলাভোলা শিবকে কাছের করে নিতে মধ্যযুগের বাঙালির কোনও অসুবিধেই হয়নি।
advertisement
11ব্রতকথার মাধ্যমে শিব চলে এলেন ঘরের ভিতরে। ছবি: দেবমাল্য দাস ৷
শিবকে ঘরের লোকে পরিণত করার কালিক প্রয়োজন ছিল, জমিও তৈরি ছিল। শেষ দিকের পালরাজাদের লিপি থেকে বেশ কিছু শিবমন্দির তৈরির কথা জানা যায়। প্রাচীন পাশুপত সম্প্রদায়ের শৈবদের জন্য রাজানুগ্রহের কথাও আছে সেখানে। সুন্দরবনে জটার দেউল, বর্ধমানের রাঢ়েশ্বর, বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর ষাঁড়েশ্বর শৈলেশ্বর-এর মতো আটশো-হাজার বছরের শিবমন্দির টিকে আছে এখনও। পাল-সেন যুগের বাংলায় শিবের যে সব মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে লিঙ্গমূর্তি বাদ দিলে শিব-পার্বতীর মূর্তি, বিশেষত উমা-মহেশ্বরের সংখ্যা খুবই বেশি। অর্থাৎ বাঙালি মননে একক শিব নয়, হরগৌরীর কল্পনাই প্রাধান্য পেয়েছে। শিব ও শক্তির এই সব যুগ্মমূর্তির পিছনে সে কালের তন্ত্রচর্চার প্রভাব দেখেছেন কেউ কেউ। সে যাই হোক, শিব ও পার্বতীর পারিবারিক রূপ যে ভাবে পরে বাঙালির সমাজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল, তার সূত্র কিছুটা হলেও যে এর মধ্যে থেকে গিয়েছে, সন্দেহ নেই।
advertisement
তেরো শতক থেকে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পর প্রথম কয়েক শতক বিশাল মন্দির তৈরি দূরের কথা, বড় আকারের পাথরের মূর্তি তৈরির পৃষ্ঠপোষকও রইল না। আক্রমণের ভয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হল দেবদেবীর মূর্তি, পুঁতে ফেলা হল মাটির নীচে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সমাজকে আবার ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হল। দেখা গেল, দিনকাল বদলে গিয়েছে। যে বিষ্ণু বা সূর্যের মূর্তি এর আগে বাংলার সর্বত্র পাওয়া গিয়েছে, সেই দেবতাদের পূজা আর ফিরল না। মুঘল আমলে এক দিকে চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম যেমন বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের আনুকূল্য নিয়ে সবাইকে টানল, তেমনই শিবের মাহাত্ম্য সবার মন জয় করে নিল। বাংলার প্রতি গ্রামে গড়ে উঠল ছোটবড় শিবমন্দির, পূজার চল হল লিঙ্গমূর্তিতে। দ্বাদশ শিব, ১০৮ শিবমন্দির তৈরি করে অভিজাতরাও পুণ্যের ভাগ নিতে এগিয়ে এলেন।
advertisement
অন্দরমহলের দরজাও কি আর বন্ধ থাকে! ব্রতকথার মাধ্যমে শিব চলে এলেন ঘরের ভিতরে। কৃষিজীবী সমাজের প্রাত্যহিক যাপনেও মিশে গেল শিবের উৎসব— সারা বাংলা জুড়ে আজও চৈত্র-বৈশাখে ‘গাজন’ হয়, যে নাম নাকি এসেছে শিববিবাহের এই লৌকিক উৎসবে সমবেত মানুষের গর্জন থেকে।
রাঢ়ের সব থেকে বড় লোক-উৎসব গাজন, উত্তরবঙ্গে আবার তারই নাম গম্ভীরা। গাজনের গানে লৌকিক শিবের কত না কীর্তিকলাপ— চাষবাস শুরুর গল্প বোধহয় সব থেকে আগ্রহ জাগায়। ‘শিবায়ন’ কাব্যেও আছে এমন গল্প। পার্বতীর পরামর্শে শিব চাষে মন দিলেন। জমি কই? ইন্দ্রের কাছে শিব জমি চাইলেন। ইন্দ্র আদিগন্ত পতিত জমি দিলেন চাষের জন্য। যম দিলেন তাঁর মহিষ, শিবের ষাঁড় আর যমের মহিষ হাল চষবে। বিশ্বকর্মা চাষের যন্ত্রপাতি বানালেন, বীজ দিলেন কুবের। হাল চষার জন্য এলেন ভীম, দশমনি কাস্তে দিয়ে ফসলও কাটলেন। ধান হল মাত্র দু’হাল। শিব বললেন, ধান পুড়িয়ে দাও। ভীম ধানে আগুন দিয়ে ফুঁ দিলেন— ধান পুড়তে লাগল, পুড়তেই লাগল। এ থেকেই তৈরি হল নানা রঙের ধান। এ গল্পের নানা মাত্রা কল্পনা করা কঠিন নয়।
অর্থাৎ শুধু শিবরাত্রিতে শিবের মাথায় জল ঢেলে ভাল বর চাওয়া নয়, শিবের মহিমা মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত অনেকটাই ব্যাপক। গবেষকদের মতে, বাংলায় এর উৎস আরও দূর অতীতে। চন্দ্রকেতুগড় তিলপি তমলুক তিলদা মঙ্গলকোট— বাংলার বিভিন্ন প্রাচীন প্রত্নস্থলে পাওয়া লিঙ্গবেষ্টনকারী বিচিত্র নারীমূর্তির ভাস্কর্যের দিকে। এখনও নাকি এ গুলির উপযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি ৷ কিন্তু শৈব কাল্ট-এর সঙ্গে এর যোগ অস্বীকার করার উপায় নেই। আর তা হলে অবশ্যই এ বিষয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ আছে।
আরও পড়ুন
শুধু বেলপাতা নয়, শিবরাত্রিতে এগুলি দিয়ে মহাদেবের অভিষেক করলে মিলবে পূর্ণ ফল
view comments
বাংলা খবর/ খবর/ফিচার/
শুধুই মেয়েলি ব্রত নয়, ছেলেরাও পালন করতে পারে শিবরাত্রি
Next Article
advertisement
Australia Woman Cricketer Molestation: বিশ্বকাপ খেলতে আসা অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেটারের শ্লীলতাহানি, ইনদৌরের রাস্তায় কী ঘটল? ধৃত অভিযুক্ত
বিশ্বকাপ খেলতে আসা অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেটারের শ্লীলতাহানি, ইনদৌরের রাস্তায় কী ঘটল?
  • অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেটারের শ্লীলতাহানি৷

  • ইনদৌরের রাস্তায় আক্রান্ত দুই মহিলা ক্রিকেটার৷

  • অভিযুক্তকে গ্রেফতার করল পুলিশ৷

VIEW MORE
advertisement
advertisement