#কলকাতা: সে কলকাতা তখন অনেক আলাদা। আমাদের তিলত্তমা নয়, বরং তিনটি বড় গ্রামের যোগফল বলাই ভাল। সেই কলকাতার বুকেই ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টা বাজিয়ে, শিউলি, কাশ, ১০৮ টা পদ্মের সুগন্ধি ছড়িয়ে ১০৮ সন্ধ্যা প্রদীপকে সাক্ষী মেনে একদিন মা এলেন। কোথায় আজকের ম্যাডক্স স্কয়ারের হাতে-হাত, দক্ষিণাপণের টক-মিষ্টি ফুচকার হাপিত্যেশ, কোথায় একডালিয়ার পায়ের ব্যথা। তখন এক রাজার জমিদারিতে তিনটি গ্রাম। সেই তিন গ্রাম নিয়েই পরবর্তীকালে তৈরি হবে এই ভালবাসার শহর। সাবর্ণ রায়চৌধুরি পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের আদি নিবাস ছিল হালিশহরে। জমিদারির মূল কাছাড়ি যদিও বড়িশায়। লক্ষ্মীকান্তের কর্মজীবন শুরু হল রাজা বসন্ত রায়ের অধীনে। পরে যশোরের রাজা এবং বারো ভুঁইয়ার অন্যতম জমিদার প্রতাপাদিত্যের আমলে তিনি হলেন ‘মজমাদার’ মজুমদার। পরে মুঘল বাহিনীকে সাহায্য করার পুরস্কার হিসাবে মহারাজ মানসিংহের সুপারিশে সম্রাট জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে এক বিশাল জমিদারি এবং ‘রায় মজুমদার চৌধুরি’ উপাধি পেয়েছিলেন।
এই পরিবারই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জব চার্নকের জামাতা চার্লস আয়ারের কাছ থেকে মাত্র ১৩০০ টাকায় গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলকাতা— এই তিনটি গ্রামের স্বত্ত্ব পেলেন। তবে সে যুগের ১৩০০ টাকা কিন্তু আজকের কয়েক লক্ষ টাকার সামিল। শহর কলকাতার গোড়া পত্তন থেকে শুরু করে দুর্গা পুজোর সূচনা, ইতিহারের পাতায় সেই থেকে মিশে গেল সার্বণ রায় চোধুরি পরিবারের নাম। জমিদারি দেখাশোনার সুবিধার জন্য লক্ষ্মীকান্ত বড়িশার (সখের বাজার) অঞ্চলে ভদ্রাসন তৈরি করেন। ‘সাবর্ণ’ আসলে এই পরিবারের গোত্র। এঁদের আসল পদবী ‘গঙ্গোপাধ্যায়’। আর ‘রায়চৌধুরি’ পাওয়া গিয়েছিল উপাধি হিসেবে। সেই থেকেই হল সাবর্ণ রায়চৌধুরি পরিবার।
বড়িশার সেই আদি বাড়িতে এখনও ইতিহাসের আদিম সাক্ষ্য বহন করে কালের ঊর্ধ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাল রঙের ১০টি থাম। আগে ছিল ১৬টি থামের এক বিশাল নাটমন্দির। সেই নাটমন্দিরের ছাদ কবেই গিয়েছে ভেঙে। এখন শুধু কোন এক পুরাকালের বিস্মৃতপ্রায় অতীত নীরবে বহন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই থামগুলো।
এই পরিবারের প্রাচীনতম বাড়ি হল আটচালা বাড়ি। এই বাড়িতেই ১৬১০ সালে কলকাতর প্রথম দুর্গাপুজোর মঙ্গল ঘট প্রতিষ্টিত হয়েছিল। কালে কালে সেই পুজোই আজ জগতজোড়া নাম করেছে। আজও পুরনো প্রথা মেনে মায়ের পুজো হয় আটচালায়। আগে শুধু আদি বাড়িতেই পুজো হত। কিন্তু সংসার বড় হতে থাকায় পরিবারের সদস্যরা এদিক ওদিক যত ছড়িয়ে গেল, পুজোর ভাগও হল তত। একটা সময় সারা কলকাতায় মোট ১০-১১টি ভাগে সাবর্ণদের পুজো শুরু হল। পরে অবশ্য কয়েকটা কমে এখন সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে আটে।
এ বাড়ির পুজোর রীতি কিন্তু এক্কেবারে আলাদা। আজও সাবেক প্রথা মতো এখানে পুজো হয় কবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী মতে। সেই পদ্ধতিতে প্রতি বছর নতুন করে দুর্গা মণ্ডপ তৈরি করার রেওয়াজ ছিল। আগে প্রতি বছর এই আটচালা তৈরি হত। মাটির তৈরি মণ্ডপ আর তার মাথায় গোলপাতার ছাউনি দিয়ে আটটি চাল তৈরি করা হত। সেখান থেকে নাম হয় আট চালা। এখন অবশ্য মাটির তৈরি সেই আটচালা আর নেই। কংক্রিটের হয়েছে। দুর্গাভক্তিতরঙ্গে পুজো করার ক্ষমতা শুধুমাত্র জমিদার বা রাজ পরিবার ছাড়া কারও ছিল না। নানা আড়ম্বড় আর আচার সমৃদ্ধ এই পুজোতে খরচ হত বিপুল। এখনও এই প্রথা মেনে পুজো হয় এই পরিবারে।
জন্মাষ্টমীর দিন হয় কাঠামো পুজো। প্রতি বছর দেবীর বিসর্জনের পর কাঠামো তুলে আনা হয়। একই কাঠামোতে প্রতি বছর পুজো হয়। পুজোর পর সেই কাঠামোর গায়ে ধীরে ধীরে বাঁশ, খড়, বিচুলি, মাটির প্রলেপ পড়তে থাকে। প্রতিমা তৈরি হয় বাড়িতেই। পুরনো পাল এসে পরতে পরতে গড়ে তোলেন মাকে। প্রতিমার গায়ের রং হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মত। অসুরের রং সবুজ। এ পরিবারের সব বাড়ির প্রতিমাই একই ধাঁচের। যাকে বলে মঠচৌড়ি বা তিন চালির। চালিরও বিশেষত্য আছে। চালির গায়ে শিল্পীর হাতের রেখায় ফুটে ওঠে দশমহাবিদ্যা, রাধাকৃষ্ণের পট, দেবাসুর সংগ্রাম। এই বাড়ির পুজোয় রয়েছে আরও এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট। মায়ের আমিষ ভোগ হয় এখানে। যদিও নিমতা (পাঠানপুর) বাড়িতে হয় নিরামিষ ভোজ। আটচালা বাড়িতে আবার বোধন হয় নবমীর দিন। অন্যান্য বাড়িতে অবশ্য সাধারণ পুজোর মতো ষষ্ঠার দিনেই বোধন হয়। আবার তেমনই অন্যান্য বাড়িতে সাধারণ সিংহ হলেও বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি আর নিমতা (পাঠানপুর) বাড়িতে সিংহ হয় ঘোটকাকৃতির। একে নরসিংহ-ও বলে। এই সিংহ অনেকটা ঘোড়ার মতো দেখতে হলেও সামনের পা দু’টো মানুষের মতো। বড় বাড়ি আর নিমতা বাড়িতে নবমীর দিন কুমারী পুজোর চল আছে। তবে একটা বিষয়ে আট বাড়ির ঠাকুরেই মিল রয়েছে। এখানে মায়ের একদিকে থাকে রাম, অন্যদিকে থাকে শিবের মূর্তি।
পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, গণেশ ও শান্তি এই পঞ্চ ঘটে দেবতার পুজো হয়। দেবীর চক্ষুদান করে সপ্তমীর সকালে পুজো শুরু হয়। তারপর নবপত্রিকা স্নান। সোনার আংটি আর সোনার আসন প্রতিমার সামনে রেখে চলে মহাসপ্তমীর থেকে মহানবমীর পুজো। সন্ধি পুজোয় মাতে চামুণ্ডা রূপে আবাহন করা হয়। পুজোর প্রতিদিনই হয় চণ্ডীপাঠ। এক সময় ১৩টি পাঁঠা আর ১টি মোষ বলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আজ যদিও তা একেবারে বন্ধ। তবে এখনও একটি ল্যাটা মাছ পুড়িয়ে তা সন্ধি পুজোয় দেওয়া হয়। আর দশমীর দিন দেওয়া হয় পান্তাভাত ভোগ। সঙ্গে থাকে কচুর শাক আর ইলিশ মাছ।
আজ থেকে ৪০০ বছর আগে কলকাতার সেই প্রাচীনতম পুজো আজও দাঁড়িয়ে আছে, নিমগ্ন হয়ে কোন সুদূরের কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে যেন হিসাব মেলাচ্ছে সে যুগের আটচালা আর আজকের কোটি টাকার থিমের...।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Durga Puja, Kolkata, Kolkatar Poila, Poila Boisakh 2019, PoilaBoisakh, PoilaBoisakh Feature, PoilaBoisakh Features, Poilar Satsotero, Sabarna Roy Choudhury, Traditional