লৌকিক দেবদেবীদের নিজস্ব জগতও বৈচিত্রপূর্ণ ৷ সেখানে মা ষষ্ঠীর পাশাপাশি পঞ্চানন ঠাকুর, মা শীতলা, মা মনসা, সত্যনারায়ণ পীর, ঘেঁটুঠাকুররা আছেন মধ্যবিত্ত ছাপোষা সংসারে বরাভয় দিয়ে ৷ এঁদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংসারের মঙ্গল অমঙ্গল, মহামারি, সন্তানের স্বাস্থ্য বা সন্তানলাভের মতো দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে সমস্যা ৷
মা ষষ্ঠী প্রথম থেকেই সন্তানের স্বাস্থ্য এবং সন্তানলাভের দেবী ৷ তাঁর মন্দির নেই, ‘থান’ আছে ৷ তাঁর নির্দিষ্ট বিগ্রহ নেই, ব্রতকথা আছে ৷ মনে করা হয় মধ্যযুগেই তিনি আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছেন বাঙালির লোকজ সংস্কৃতিতে ৷
বারো মাসে যে কতগুলি ষষ্ঠীব্রত প্রচলিত, তা মনে রাখার জন্য একটি ছড়া আছে-
‘‘জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্যষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
শ্রাবণ মাসে লোটনষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
ভাদ্র মাসে মন্থনষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
আশ্বিন মাসে দুর্গাষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
অঘ্রাণ মাসে মূলাষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
পৌষ মাসে পাটাইষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
মাঘ মাসে শীতলষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
চৈত্র মাসে অশোকষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট
বারো মাসে তেরোষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট’’
‘অরণ্যষষ্ঠী’ ব্রতকথার শেষে পাঠ করা হয় এই ছড়া ৷ এই ‘অরণ্যষষ্ঠী’-ই পরিচিত জামাইষষ্ঠী নামে ৷ সন্তানের মঙ্গলকামনায় সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে জামাইরাও ৷ একদিকে মাছের রাজা ইলিশ, অন্যদিকে ঋতুর সেরা ফলগুলির সমাহার, এই দুই যুগলবন্দির জন্য হয়তো এই ষষ্ঠীটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে জামাতা-আপ্যায়নের জন্য ৷
শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের যাতে কষ্ট না হয়, তাই বছরে একদিন বাবাজীবনকে ডেকে আদর তোয়াজ, জামাইষষ্ঠীর পিছনে এই কারণটিকেই মুখ্য বলে মনে করেন গবেষকরা ৷ তা ছাড়া মেয়ে যাতে সন্তানহীনা না হয় এবং জামাইও যেন ‘ছেলের মতো’ হয়ে ওঠে, মা ষষ্ঠীর কাছে থাকত সেই সুপ্ত বাসনাও ৷
বাবু সংস্কৃতির যুগে জামাইষষ্ঠী যে স্টেটাস সিম্বল হয়ে উঠেছিল, সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে ৷ সেকালে জামাইষষ্ঠীর তত্ত্বের উপর নির্ভর করত কুটুমবাড়িতে মানসম্মান ৷ জামাইয়ের সঙ্গে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসতেন তাঁর ভাইবোন এবং মাঝে মাঝে, অন্য পরিজনও ৷ এবং, জামাইষষ্ঠীর নির্দিষ্ট তিথি থাকলেও অনেক সময়েই জামাইয়ের শ্বশুরবাড়িযাপন পেরিয়ে যেত মাসাধিক কাল৷
বাবু কলকাতার বনেদি বাড়িতে জামাইষষ্ঠীর প্রস্তুতি শুরু হত অনেক দিন আগে থেকেই৷ কোন বাড়ির চকমিলানো দালানে ভোজ বেশি জমকালো হল, সে নিয়ে রেষারেষি ছিল ষোলআনা ৷ আপ্যায়নের ফাঁকে থাকত জামাইঠকানো ফাঁদ ৷ সেই ফাঁদ পাততেও রীতিমতো কসরত করতেন বাড়ির গিন্নিরা ৷
হুগলির প্রসিদ্ধ মিষ্টি ব্যবসায়ী সূর্যকুমার মোদকের ডাক পড়েছিল তেলিনীপাড়ার জমিদারবাড়িতে ৷ জমিদারগিন্নির আব্দারে তৈরি করতে হবে ‘জামাইঠকানো সন্দেশ’ ৷ সূর্য ও তাঁর ছেলে সিদ্ধেশ্বর দিনরাত এক করে ভাবতে লাগলেন নতুন কারিগরি৷ গরমে ফলের ঝুড়িভর্তি তালশাঁসই তাঁদের চোখ খুলে দিল৷ সন্দেশ তৈরি করলেন তালশাঁসের আকারে ৷ বাইরে নিরেট, ভিতরে ফাঁপা ৷ সেই ফাঁপা অংশে ভরা হল গোলাপের সুগন্ধিতে জারানো গুড়ের পাকের চিনি বা দোলোর রস ৷ এ বার মাহেন্দ্রক্ষণে জামাইয়ের মোক্ষম কামড়ে সেই রস এসে পড়ল তাঁর পরনের দামী পাঞ্জাবিতে ৷ মহিলামহলের হাসির ফোয়ারাতেই বাংলার মিষ্টি-মানচিত্রে যাত্রা শুরু করল ‘জলভরা তালশাঁস’ ৷
প্রায় ১৩৮ বছর পেরিয়েও সেই জলভরা তালশাঁসের চাহিদা এখনও তুঙ্গে ৷ জানালেন দোকানের বর্তমান মালিক শৈবাল মোদক ৷ এছাড়াও শ্বশুরমশাইরা বেছে বেছে কেনেন ক্ষীরপুলি, মতিচূড়, রাজনন্দিনী ৷ শৈবাল বললেন, ‘‘বাঙালির জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা মিষ্টিমুখ ছাড়া অচল৷ তবে গত বছরের মতো এ বছরও ক্রেতা কম ৷ কারণ গণপরিবহণ না থাকায় বাইরে থেকে ক্রেতারা আসতে পারছেন না৷’’ তাই কুরিয়ারেই মিষ্টি পাঠাচ্ছেন সূর্যকুমার মোদকের উত্তরসূরি শৈবাল ৷ জানালেন, এ বছর তাঁদের ‘বউমা ষষ্ঠী’ ছাপওয়ালা সন্দেশের চাহিদাও বেশ ভাল ৷
কুরিয়ার পরিষেবার উপর ভরসা করে আছেন কলকাতার আর এক নামী মিষ্টি বিক্রেতা, ‘বলরাম মল্লিক অ্যান্ড রাধারমণ মল্লিক’৷ কর্ণধার সুদীপ মল্লিকের কথায়, ‘‘জামাইষষ্ঠীর নিয়মকানুন আগের থেকে কমে গিয়েছে৷ কিন্তু উপহার বা খাওয়াদাওয়ার রীতি একটুও কমেনি ৷ আর কিছু না হোক, মেয়ে জামাইকে আম-মিষ্টি পাঠাতেই হবে৷’’ এ বছর চাহিদা কম হলেও কুরিয়ারে তাঁরা মিষ্টি পাঠাচ্ছেন ৷
সুদীপ বললেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের মিষ্টির বিশেষত্ব হল ফলের উপস্থিতি ৷ ‘‘আগে কিন্তু বাঙালি মিষ্টিতে এত ফলের আসাযাওয়া ছিল না৷ আমরাই এই ধারা শুরু করেছি ৷ দেখেছিলাম, বাজারে গরমের মরসুমি ফল এলে মিষ্টি বিক্রি কমে যায় ৷ তাই আমি মিষ্টির মধ্যেই ফল ঢুকিয়ে দিলাম ৷ আমাদের লিচু সন্দেশ, লিচুর পায়েস, আতার পায়েস, আতার সন্দেশ, তরমুজের সন্দেশ, কাঁঠাল সন্দেশের খুব চাহিদা থাকে এ সময়ে৷’’
ফলের সুবাসিত উপস্থিতি থাকে নলিনচন্দ্র দাসের রকমারি দইয়েও ৷ শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের বিশেষত্ব হল, কোনও রসের মিষ্টি তৈরি করা হয় না ৷ বরং রাবড়ি ও দইয়ে ডুব দেয় আলফানসো আম ৷ রাবড়িতে মিশে যায় স্ট্রবেরি ৷ ‘‘ তবে জামাইষষ্ঠীতে ট্র্যাডিশনাল দই ও রাবড়িই ক্রেতারা বেশি চান ৷ এ বছর মালাই দইয়ের চাহিদাও খুব বেশি ৷ আছে ছানার পায়েসও ৷ ’’ বললেন দোকানের কর্ণধার তপনকুমার দাস ৷ তাঁরাও দই সন্দেশ পাঠাচ্ছেন কুরিয়ারে ৷ অনলাইন পরিষেবার পাশাপাশি আছে তাঁদের নিজস্ব ডেলিভারি ব্যবস্থা ৷ অতিমারিকালে প্রায় লকডাউনে রথী মহারথী মিষ্টি ব্যবসায়ীদের ভরসা এই দূরমাধ্যমই ৷
মিষ্টিবিলাসের হাজারো আয়োজন থাকলেও অনেক এদেশীয় বা ঘটি পরিবারে জামাইষষ্ঠীতে আচার অনুষ্ঠান পালন করা হলেও খাওয়াদাওয়া হয় অন্যদিন ৷ কারণ সে দিন বাড়িতে সন্তানের মায়েরা উপবাস করেন এবং নিরামিষ খান ৷
তবে যে কোনও ষষ্ঠী ব্রতর প্রচলন বাঙালদের তুলনায় ঘটিবাড়িতে অনেক বেশি ৷ ভোজনবিলাস সামর্থ্য অনুযায়ী যে রকমই হোক না কেন, ষষ্ঠীর সকালে দুব্বোঘাসবাঁধা, জলে ভেজা তালপাতার পাখার বাতাসে ‘ষাট ষাট ষাট’ আকুতিতে মিশে থাকে মায়েদের একটাই প্রার্থনা, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’৷
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Aranyasasthi, Jamaisasthi