কৃষ্ণনগরের মৃতপ্রায় মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি নয়, সুরহা চান শিল্পীরা
Last Updated:
কৃষ্ণনগর পরিক্রমা ২: কেমন আছে এখানকার পুতুলপট্টি ? প্রাচীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কতটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে? কতটা পেয়েছেন, কতটা পাননি? সামনেই ভোট এই শহরে ৷ কী চাইছেন ঘূর্ণীর মৃৎশিল্পীরা?
#কৃষ্ণনগর: কর্কটক্রান্তি রেখার সুবাদে এখন তাপে পুড়ছে কৃষ্ণনগর ৷ বেলা ৮টা বাজতে না বাজতেই রোদের তেজে ঝলসে যাচ্ছে চামড়া ৷ আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভোটের উত্তাপও ৷ চতুর্থ দফায় কৃষ্ণনগরে ভোট ৷ তার আগে ঘাস-পদ্ম-হাত-কাস্তের ওমে নিজেদের এখন সেঁকে নিচ্ছে প্রাচীন এই ঐতিহ্যের শহর ৷
এই শহরের রাজনৈতিক চালচিত্র বেশ আকর্ষণীয় ৷ একসময় নকশাল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নাম লিখিয়েছিল এই শহর ৷ বরাবরই এখানে বামেদের শক্ত ঘাঁটিও ছিল ৷ কিন্তু উল্লেখযোগ্য এই যে যখন রাজ্যের কোথাও পদ্মের চিহ্নমাত্র ছিল না, তখনও কৃষ্ণনগরে বরাবর ভাল সংখ্যক ভোট পেয়ে আসছে বিজেপি ৷ ১৯৯৯-এ এখানকার প্রভাবশালী সাংসদ ছিলেন সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (জুলুবাবু) ৷ আর এবারের ভোটে কৃষ্ণনগরের এক্স ফ্যাক্টর কী? বিজেপি হাওয়া কি ভোট বাক্সে প্রভাব ফেলবে? নাকি জোড়া ফুলেই আস্থা রাখতে চান কৃষ্ণনগরবাসী?
advertisement
advertisement
কৃষ্ণনগর বললেই মনে আসে এখানকার মাটির পুতুলের কথা ৷ ভোটের আগে এই শহর পরিক্রমায় প্রথমেই ঢুকে পড়া গেল সেই পুতুলদের সংসারে ৷ কেমন আছে এখানকার পুতুলপট্টি ? প্রাচীন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কতটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে? কতটা পেয়েছেন, কতটা পাননি? সামনেই ভোট এই শহরে ৷ কী চাইছেন ঘূর্ণির মৃৎশিল্পীরা? পায়ে পায়ে এ দোকান, ও দোকান....দেখা গেল প্রতিশ্রুতি আর কাজের মধ্যে ফারাকটা এখানে বড্ডই বেশি ৷
advertisement
কাজে মগ্ন শিল্পী ৷
অনেকে বলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নামে নাকি এ শহরের নাম কৃষ্ণনগর। কিন্তু এ তথ্য ভুল। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে কৃষ্ণনগরের নাম শ্রী কৃষ্ণের নাম থেকে এসেছে। এই নাম দিয়েছিলেন মহারাজা রুদ্র রায়। যিনি কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। কৃষ্ণনগরের বৈভব, নামডাক আর জনপ্রিয়তার সঙ্গে অবশ্য ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে গিয়েছে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। সুদক্ষ শাসক আর সুকৌশলী রাজনীতিবিদ ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ছিলেন প্রকৃত গুণের কদরদার। সে জন্যই তার দরবারহল পরিপূর্ণ থাকত রাজ্যের শ্রেষ্ঠ মণিরত্ন দিয়ে। মধ্যযুগের অন্যতম বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র ছিলেন তাঁর সভাকবি। এ ছাড়া সাধককবি রামপ্রসাদ সেন, পন্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত তাঁর রাজসভায় জ্বলজ্বল করত। হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড় ছিলেন তাঁর দরবারের প্রখ্যাত বিদূষক। যদিও গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্ব নিয়ে পরে নানারকম প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে।
advertisement
কৃষ্ণচন্দ্রের উৎসাহ ও উদ্যোগে নাটোর থেকে বহু মৃৎশিল্পী কৃষ্ণনগরে চলে আসেন। তাঁরাই কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের প্রসার ঘটান। এঁদের মধ্যে কেউ প্রতিমা গড়তেন । কেউ গড়তেন মাটির পুতুল। ধীরে ধীরে এটাই হয়ে ওঠে এলাকাবাসীর মুখ্য জীবিকা। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিগ্রামে শুরু হয় এ শহরের আর এক গৌরবময় ইতিহাস। একদিন সারা বিশ্বের কাছে ঘূর্ণির পুতুলপট্টি পরিচিত হয়ে ওঠে মাটির পুতুলের আঁতুড়ঘর নামেই। কৃষ্ণনগরের বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা যে রাস্তাটা তেহট্ট-করিমপুরের দিকে যাচ্ছে সেই রাস্তাটি হল ১১ নম্বর জাতীয় সড়ক। বাসস্ট্যান্ড থেকে কিলোমিটার খানেক এগোলেই পুতুলপট্টি। সেখানে রাস্তার ডানে-বামে অনেকটা এলাকা নিয়ে ঘূর্ণি গ্রাম। এখন অবশ্য সেখানে গ্রামের গন্ধ খুঁজতে যাওয়া বোকামি হবে। রাস্তার দু’ধারে বাহুল্য বর্জিত খুব সাদামাঠা দোকান। দেখে কে বলবে এরই খ্যাতি নাকি জগৎবিখ্যাত! কিন্তু আসল ঐশ্বর্যের গুপ্ত কুঠুরি তো রয়েছে ওই মামুলি দোকানগুলোর অন্দরে। ছোট্ট সিঁড়ি টপকে দোকানে পা রাখতে গিয়েই ধাক্কা খেতে হয়। মনে হয় সাদা ধবধবে ডানা মেলা ওই পরি বোধহয় রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসে স্থির হয়ে গিয়েছে। একটু ছুঁয়ে দিলেই ডানা মেলে উড়ে যাবে পক্ষীরাজের দেশে। এতটাই জীবন্ত সে। ভিতরে ঢুকলে আরও বিষ্ময় অপেক্ষা করে আছে। কৃষ্ণনগরের বিশেষত্ব ‘রিয়্যালিস্টিক হিউম্যান য়িং’-এ। খোল-করতাল নিয়ে বোষ্টম-বোষ্টমীর দল চলেছে। অদ্ভুত নিপুণতায় ফুটে উঠছে তাঁদের মুখের ভাঁজ, পায়ের আঙুল বা গলার শিরা। আদিবাসী দম্পতিদের পালকের বস্ত্র, পাতার অলঙ্কার যেন হাত দিয়ে ছুঁলেই জ্যন্ত হয়ে উঠবে।
advertisement
আর আছে দেবদেবীর মূর্তি। এই অধ্যায় বাদ দিয়ে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প অসম্পূর্ণ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফিগারেও মুকুটের ডিজাইন, চালচিত্রের নক্সা, শাড়ির পাড়ের কল্কা একেবারে পরিষ্কার। শুধু কী তাই? দেবী মূর্তির ওই ঢলঢল মুখে পটলচেরা টানা চোখ, পেলব কোমর, আলতো আঙুল...কৃষ্ণনগর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আবার এই কৃষ্ণনগরের বুকেই দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী মায় সরস্বতী পুজোতেও দোতলা সমান উঁচু ঠাকুরের মাথা-হাত-পায়ের একেবারে নিখুঁত সামজ্জস্য দেখে তাক লাগতে বাধ্য। অন্তত ৪টি জাতীয় পুরষ্কার রয়েছে এই পুতুলপট্টির ঘরে। রয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিল্পীরাও। কার্তিক পাল, সুবীর পাল, গণেশ পাল, মুক্তি পাল, ত্বড়িৎ পাল...কৃষ্ণনগরের মাথাকে উজ্জ্বল করেছেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাতীয়পুরষ্কার পেয়েছিলেন সুবীর পাল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সামনে দাঁড় করিয়ে তাঁর মর্মর মূর্তি তৈরি করে পুতুলপট্টিকে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার এনে দিয়েছিলেন স্বনামধন্য কার্তিক পাল।
advertisement
কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন শিল্প আজ কেমন আছে? লোকসভা ভোট এখন দোরগোড়ায়। নির্বাচন তো বারবারই ফিরে আসে? না পাওয়াগুলো মেটে কী? কেমন থাকে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের সংসার? উত্তর খুঁজতে ঢুকলে দেখা যাবে কাদা মাটির নীচে নিকষ অন্ধকার। ঘূর্ণির ঘূর্ণিপাকে পাক খাচ্ছে শূণ্যতা আর হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। এবারের নির্বাচন থেকে কী চাইছে পুতুলপট্টি? পটুয়া পাড়ার শিল্পীরা জানাচ্ছেন, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটে চলা এই সংসারে আর তেমন কদর নেই সূক্ষ্ম মাটির পুতুলের। এ কাজে লাগে প্রচুর সময়, অপরিসীম ধৈর্য আর নিখুঁত শৈল্পীক মন। সেই কাজকে কদর করার, তার দাম দেওয়ার মানুষই বা কই? মাটির ঘরসংসারে এখন তাই নতুন অতিথি প্লাস্টার অব প্যারিস। যেখানে হাতে করে একটা পুতুল গড়তে সময় লাগে কমপক্ষে ৫দিন, সেখানে ছাঁচের পুতুল দিনে ১০০টা তৈরি করা যায়। আদমানি-রপ্তানি করতেও মাটির তুলনায় ফাইবার, স্টোন ডাস্ট আর প্লাস্টার অব প্যারিসের চাহিদাই বেশি।
advertisement
আর নতুন প্রজন্ম? তাঁরাও আর উৎসাহী নয় বাপ-ঠাকুরদার এই কাজে। আজকাল চাহিদা নেই তেমন, পর্যটন দফতরও ঘুরে তাকায়নি কৃষ্ণনগরের দিকে। জিএসটি-র ফলে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আগে মায়াপুর থেকে বহু বিদেশী পর্যটক আসতেন। সে সময় বিক্রিবাটা হত ভালই। আজ সেই পর্যটকদের যদি ১০ শতাংশকেও কৃষ্ণনগরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা থাকত, এখানে থাকা-খাওয়া বা সিটি ট্যুরের মতো ব্যবস্থা হত...আক্ষেপ ঝরে পড়ে শিল্পীর গলায়। এখানে মিউজিয়াম তৈরির কথা হয়েছিল, কিন্তু তা আর সূর্যের আলো দেখেনি। বিখ্যাত শিল্পীদের কাজের কোনও সংরক্ষণও নেই। শিল্পীরা কাজের দাম না পেলে কাজ করবেন কেন? ফাঁকা দোকানে মাছি তাড়াতে তাড়াতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন পুতুলপট্টির এক মৃৎশিল্পী। তাঁর কথায়, তবু সব শেষের পরেও সব কী যায়? অতীতের গৌরবগাথার সেই চাকচিক্ক্য বালির নীচে বইতে থাকে ফল্গু ধারার মতো। সেই রেশ ধ্বনিত হতে থাকে কৃষ্ণনগরবাসীদের কানে, মনে, মননে। আজও কিছু কারিগর হাতের জাদুতে কথা ফোটান মাটিতে... আশা করেন ফের একদিন নতুন প্রজন্ম ফিরে তাকাবে এই শিল্পের দিকে।
এক সময় চলতি কথায় বলা হত, ‘আহা মুখখানা ঠিক যেন কেষনগরের মাটির পুতুল।’ সেই প্রচলিত শব্দবন্ধ যেন কোনওদিন মিথ্যে না হয় তারই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েকশ শিল্পীর আশ্চর্য আঙুল।
view commentsLocation :
First Published :
April 26, 2019 4:40 PM IST