বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের দেড়শো বছর৷ পরিচালক দেবাশিস সেই উপলক্ষে ‘থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম’ দলে তৈরি করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘নূরজাহান’ নাটকটি৷ মূল নাটকটি বহরে অনেক বড়৷ সম্পাদনা করে দু’ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের বেড়ায় বেঁধেছেন তিনি এই নাটককে৷ ইতিহাস চিন্তকেরা হয়ত নাটকের প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে অনেক কথা বলতে পারবেন, বলতে পারবেন নাট্যকার কতটা ঐতিহাসিক তথ্যের প্রতি সৎ থেকেছেন৷ কিন্তু আমরা আজ না হয় সেসব কথা বললাম না, বরং নির্মাণ নিয়ে হোক আমাদের আজকের এই আলোচনা৷
দেবাশিসের কাজ যাঁরা নিয়মিত দেখেন, তাঁরা জানেন, তিনি শুধু মাত্র আধুনিক চিন্তনের নাট্য নির্মাতা তাই নন, তিনি ক্লাসিক্যালের উল্টোপিঠে দাঁড়ানো এক উদ্ধত, নির্দিষ্ট বক্তব্য৷ নির্মাণের ক্লাসিক চেতনার থেকে তাঁর নির্মাণ স্বত্তা লাফিয়ে লাফিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছে৷ তিনি বৃত্তের বাইরে রাখছেন নিজের চিন্তাকে৷ যে ভাবে আলোকবর্ষ পেরিয়ে তরঙ্গের মতো কাঁপতে কাঁপতে তারার আলো এসে ধাক্কা খায় আমার-আপনার চোখে, দেবাশিসের নির্মাণ তেমনই, তরঙ্গের মতো সুক্ষ কিন্তু তীব্র, ইন্দ্রিয়কে তা আঘাত করতে বাধ্য৷ ‘প্রথম রাজনৈতিক হত্যা’, ‘রাবন রিলোডেড’-এর নির্দেশক এখানেই আলাদা৷ মঞ্চের চলিত জ্যামিতিকে তিনি প্রথমেই ভেঙে দিয়েছেন সানন্দে৷
দেবাশিসের দ্বিতীয় নির্মাণ নৈপুন্যের পরিচয় তাঁর ‘স্পেস’ ও ‘প্রপ’-কে ব্যবহারের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতায়৷ প্রসেনিয়ামের নির্দিষ্ট নিয়মের গণ্ডী ভেঙে দেন তিনি বাংরবার৷ মঞ্চের উপরে যা আছে, আশেপাশে যা আছে, সব, সবই নাটকের অংশ হয়৷ কখনও সেটা মঞ্চের দু’পাশের সিঁড়ি, কখনও পর্দা, কখনও মঞ্চের সামনের পরিসর৷ কেতাবী অর্থে আরও কঠিন করে এই তত্ত্বের কথা উল্লেখ করা যেত বটে, তবে এ ক্ষেত্রে মোদ্দা কথা হল, দেবাশিস এই নাটকে এমন কিছু স্পেসের ব্যবহার করেন বাংরবার, যা দৃশ্যকাব্যের মিতাক্ষর চেতনাকে আঘাত করে৷ ‘নূরজাহান’ তাই এক নব আবিস্কার৷
দেবাশিস নিজে এই নাটকে জাহাঙ্গীরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, রায়তী ভট্টাচার্য অভিনয় করেছেন ‘নূরজাহানে’র ভূমিকায়৷ প্রতিবাদী ‘লায়লা’র চরিত্রে অ্যাফ্রোদিতে রায়, ‘শের খাঁ’-এর চরিত্রে সৌরভ সাহা, ‘শাহাজাহানে’র চরিত্রে রাজু ধর ও ‘খসরু’-র চরিত্রে অভ্যুদয় দে৷ এই নামগুলি ছাড়াও আরও জনা পঁচিশেক নাম আছে অভিনেতার৷ উল্লেখ করলে সকলেরই করতে হয়, তবু এঁদের নাম আলাদা করে উল্লেখ করার কারণ, এঁরা কোথাও বাকিদের তুলনায় একটু করে এগিয়ে গিয়েছেন৷ তবে দেবাশিসের নৈপুন্যে এখানেও, যে তিনি কাপ্তান বাবুর মতো কাউকে ‘শো’-অফের সুযোগ দেননি, বেঁধে দিয়েছেন, শিল্পের দড়িতে, যা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ অধুনা বাংলা নাটকে অনেক ‘নায়ক সুলভ’ অভিনেতাই বুঝে গিয়েছেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোন দিকে কাঁধ ঝাঁকালে নারী হৃদয়ে হিল্লোল তোলা সম্ভব, তাই প্রয়োজন না হলেও তাঁরা মঞ্চে উঠে তেমন করছেন৷ দেবাশিস বুঝিয়েছেন, নাটক আগে, শিল্পীর ব্যক্তিগত ঝলক, পরে৷
এই নাটকের সমস্ত কথাতেই বারংবার দেবাশিসের নাম আসবে, কারণ, আলো, মঞ্চ, সম্পাদনা ও নির্দেশনা এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়, সবই দেবাশিস একাই করেছেন৷ তপন থিয়েটারের যে শো দেখতে আমি গিয়েছিলাম, সেখানে তার বাইরেও একটি নাম আলাদা করে জানতে চেয়েছিলেন দর্শকেরা৷ সঙ্গীতশিল্পীর নাম৷ এই নাটকে অসংখ্য গান ব্যবহৃত হয়েছে৷ একটি শানিত গানের দল আগাগোড়া নাটকের বিভিন্ন ইমোশনকে ধরতাই দিয়েছেন গানে৷ গানের দলে ছিলেন, জয়দীপ সিনহা, মঞ্জিমা চট্টোপাধ্যায়, তালবাদ্যে ছিলেন অভ্যুদয় দে, পৃথ্বীরাজ চৌধুরী, এ ছাড়া সহ-শিল্পীরা হলেন শুভ্রজিৎ সেনগুপ্ত, অনীক সেনগুপ্ত, মৈনাক মুখোপাধ্যায়৷ গানের গবেষণার কাজ করেছেন ভাস্কর মুখোপাধ্যায়, বাংলা নাটকে ক্রমে নিজেকে উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করছেন তিনি৷ এই নাটকের সহকারী নির্দেশনার পাশাপাশি ভাস্কর পোশাক ও আবহের কাজও করেছেন, যাতে তাঁর চিন্তার অদ্ভুত দার্শনিকতাও উপচে ওঠে৷
নূরজাহান কোনও কালের নাটক নয়৷ আসলে ইতিহাসকে ক্ষমতার চাতাল থেকে সূর্যের আলো আড়াআড়ি করে ফেলে এক ব্যবচ্ছেদ করার অপরেশন টেবিল৷ নূরজাহান চরিত্রটিও কোনও লিঙ্গ, জাতি ভেদ মানে না, শুধু অবক্ষয়ের সময়ে ক্ষমতার এক প্রতিরূপ হয়ে সে গেয়ে যায় নিজেরই রূদালি৷ সে জানে ধ্বংস অনিবার্য, মৃত্যু নিশ্চিত, তবু তাঁকে পেয়ে বসে ক্ষণিকের ক্ষমতার মত্ততা৷ বিশ্বের প্রান্তরে যখন মাঝে মাঝেই উচ্চস্বরে, সদর্পে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যায় ফাসিস্ত শক্তিকে, যখন স্বৈরাচার জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে, তখন ‘নূরজাহান’-এর আয়নার আলোয় যাঁরা নিজের মুখ দেখতে পান, তাঁদেরকে সতর্ক করে দেবাশিসের এই নাটক৷
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Bengali Theatre