সংসারের ভার কাঁধে! জনতা কার্ফুর দিনেও খবর বেচলেন ৮১ বছরের 'খবর বুড়ি'
- Published by:Simli Raha
Last Updated:
SUJIT BHOWMIK
#খেজুরি: খেজুরির কাগজ বুড়িকে মনে আছে? যাঁকে বয়সের ভার হার মানাতে পারেনি। ৮১ বছর বয়সেও যিনি প্রতিদিনই রাস্তায় নেমে খবর "বেচে" চলেন। ৮১ বছরের সেই কাগজ বুড়ি, বাসন্তী ত্রিপাঠী আজও জনতা কার্ফুর দিনেও নিজের কাজ বাঁচিয়ে রাখতে নেমেছিলেন রাস্তায়। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের দিনটা অন্যরকমই ছিল। রাস্তায় ছিল না লোকজন। বন্ধ ছিলো গাড়ি, দোকানপাট। তবুও তিনি হাতে কাগজ নিয়ে আজ খেজুরির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। কারণ, আজকের কাগজ কাল "বাসি" হয়ে যাবে। পরদিন বিক্রি করা যাবেনা একদিন আগের খবরের কাগজ। তাই আজও গোটা খেজুরি যখন গৃহবন্দী, তখনও আজকের দিনে খবর বেচতে রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছেন তিনি। কাগজ বিলি করেছেন গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি।
advertisement
আসলে অভাবের তাড়নায় নিজের লড়াইটা ৮১ বছর বয়সেও জারি আছে খেজুরির কাগজ বুড়ির। আজ জনতা কার্ফুর দিনেও পথে নেমে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন খেজুরির বাসন্তী ত্রিপাঠী। লড়াইটা দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরেই লড়ে আসছেন তিনি। রাস্তায় নেমে কাগজ হকারি করে জীবন গুজরান করার লড়াই। কঠিন সেই লড়াইয়ের শুরুটা আজ থেকে প্রায় চার দশক আগেই শুরু করেছিলেন খেজুরি দু নম্বর ব্লকের প্রান্তিক এলাকার বাসিন্দা ৮১ বছর বয়সের বাসন্তী ত্রিপাঠী নামের এই বৃদ্ধা। বেঁচে থাকার তাগিদেই ঘর ছেড়ে বাড়ির গৃহবধূ বাসন্তীদেবীকে রাস্তায় নামতে হয়েছিল খবরের কাগজ হাতে। আজ থেকে চার দশক আগের সময়কালে বাড়ির মহিলাকে কাগজ হাতে হকারি করতে বাধা দিয়েছিলেন প্রায় সব্বাই। তাঁর কাগজ বিক্রির কাজ মেনে নেয়নি পাড়া প্রতিবেশী কেউই। প্রথম দিকে তাঁর কপালে জুটেছিলো অপমান আর কটুক্তি। কিন্তু লড়াইটা যেহেতু পেটের তাগিদেই শুরু করেছিলেন, সে কারণেই তিনি সব বাধা উপেক্ষা করে লড়াই চালিয়েই গিয়েছেন।
advertisement
advertisement
এভাবেই কেটে গিয়েছে ৩৭টা বছর। লড়াই তবুও থেমে নেই। ৮১বছর বয়সে এসেও তাঁর লড়াই জারি রয়েছে। বার্ধক্য ও শারিরীক অসুস্থতা সত্বেও দিনের পর দিন খবর বেচেই চলছেন তিনি। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরী ২ ব্লকের প্রান্তিক এলাকায় গেলেই দেখা মেলে কঠিন লড়াইয়ের সেই মুখ- কাগজ বুড়িকে। আসল নাম বাসন্তী ত্রিপাঠী হলেও পাঠক থেকে স্থানীয় মানুষজন, সকলের কাছেই তিনি পরিচিত কাগজ বুড়ি নামেই। তবে অনেকেই তাঁকে সম্মান দিয়ে কাগজ মাসি বলেও ডাকেন। লড়াইটা কঠিন। আজকের দিনের কাগজ বুড়ির কাগজ বিক্রির শুরুটা মোটেও সহজ ছিলনা। ৩৭বছর আগে সংসারে অভাব অনটন দেখা দিলে আয়ের পথ খুঁজতে খুঁজতেই কাগজ বিক্রির সন্ধান পেয়েছিলেন। সেসময় তাঁর এক আত্মীয়ের পরামর্শে কাঁথি থেকে একটি নতুন স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা বিক্রি করা শুরু করেছিলেন। নতুন পত্রিকা হওয়ায় শুরুতে কাগজ বিনামূল্যে পেতেন দশ কপি করে । ফলে কাগজ বিক্রির টাকা পুরোটাই নিজের হয়ে যেত। তাই শুরুতে বেশি বেশি মানুষকে কাগজ বিক্রি করার ঝোঁক বাড়ছিল।
advertisement

তখন খেজুরীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াতেন হাতে কাগজ নিয়ে। ধীরে ধীরে এলাকার পাঠকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুধু স্থানীয় পত্রিকা নয়, পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত কাগজের গ্রাহকও হলেন অনেকে। যা বর্তমানে কয়েকগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, অফিস থেকে থানা ও স্থানীয় সরকারি বিভিন্ন দফতরে এখনও নিজের হাতে কাগজ দিয়ে আসেন কাগজ বুড়ি। সকাল ছ'টায় কাগজ সংগ্রহ করে কলাগেছিয়া বাসস্ট্যান্ডে কিছু সময় কাগজ বিক্রির পর রওনা দিতেন খেজুরীর উদ্দ্যেশে । খেজুরীর কুঞ্জপুর , জনকা, বিদ্যাপীঠ বাজারে কাগজ বিক্রি করে ফিরতেন রাতের হেড়িয়াগামী শেষ বাস ধরে। কোনও কোনও দিন বাস ফেল হলে স্থানীয় পথ চলতি সাইকেল, মোটর সাইকেল করে ফিরতেন। আজও সেই ধারা অব্যাহত রেখেই নিজের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
advertisement
আজ করোনা বিপদ নিয়ে সবাই যখন ঘরেই আছেন, সেদিনও, অর্থাৎ জনতা কার্ফুর দিনেও তাঁর লড়াই চালালেন নিজের মতো করেই। একজন নারী জীবন যুদ্ধে লড়াই করে যে বাঁচতে পারে, তারই প্রমাণ রাখতেই আজকের এই কঠিন দিনেও বন্ধ নেই কাগজ বুড়ির সেই লড়াই। এলাকার মানুষের কথায়, খেজুরীর দক্ষিণাঞ্চলের প্রান্তিক এলাকার মানুষজনের সঙ্গে খবরের কাগজের সংযোগ ঘটিয়েছিলেন এই কাগজবুড়িই। সবাই বলেন, কাগজ বুড়ি আমাদের অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত । হতাশায় অনেকে নিজের জীবনকে শেষ করে ফেলার কথা ভাবেন, কাগজ মাসিমাকে দেখলে তাঁদের হতাশা দূর হবে এবং জীবন যুদ্ধে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা যোগাবে। খেজুরীর কলাগেছিয়ার বাসিন্দা বাসন্তী ত্রিপাঠী তথা কাগজ বুড়ি আজও তার পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। ছেলে কালীশংকর ত্রিপাঠী ব্যবসায় কাগজ বিক্রির কাজে হাত লাগালেও শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। এক বৌমা ও দুই নাতিনাতনি নিয়ে ৮১ বছর বয়সেও টেনে চলেছেন সংসার তিনিই। সংসারের প্রয়োজনেই তাঁর লড়াই চলছে, চলবেও। বলছেন তিনি নিজেই।
Location :
First Published :
March 22, 2020 8:24 PM IST