কিন্তু ইতিমধ্যেই মানুষের সমাজে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়া নিয়ে। আসলে মানুষের নিরাপত্তার জন্য, সুবিধার জন্য যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে মানুষের সমস্যা তৈরি করতে।
এমনই একটি ঘটনার কথা সম্প্রতি জানা গিয়েছে। আমেরিকান এক মহিলা তাঁর ১০ বছরের বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরতে চাইছিলেন। স্বামীর বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ ছিল। কিন্তু মহিলার দাবি, তাঁর Mercedes-Benz C300 গাড়িটির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জারি রেখেছিলেন ভদ্রলোক। তাই বাড়ি ছাড়লেও নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে স্ত্রী কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন সব কিছুর উপর নজরদারি চালাতেন তিনি।
advertisement
আরও পড়ুন: এই অ্যাপগুলি ডাউনলোড করেছেন নাকি আপনার স্মার্টফোনে! ঘনিয়ে আসছে মারাত্মক বিপদ
ওই মহিলার অভিযোগ এই বিষয়ে গাড়ি নির্মাতা সংস্থার সঙ্গে কথা বলেও কোনও লাভ হয়নি। কারণ গাড়িটি মহিলার নিজের হলেও সেটি কেনার সময় ব্যাঙ্ক ঋণ করা হয়েছিল স্বামীর নামে। ফলে ‘Mercedes me’ অ্যাপের সঙ্গে ‘Mbrace’-এ সম্পূর্ণ অধিকার ছিল ওই ব্যক্তির। এই অ্যাপের সাহায্যেই তিনি স্ত্রীর চলাচলের উপর নজরদারি চালাতেন। এই সংযোগ বন্ধ করার অনুরোধ রাখেনি সংস্থা। বরং ওই মহিলা বাধ্য হয়ে স্থানীয় এক কারিগরের কাছে গিয়ে গাড়ির প্রযুক্তিকে বন্ধ করিয়ে নেন। তার ফলে তিনি হারান নেভিগেশন সিস্টেম এবং SOS বাটন।
আসলে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে গাড়িও এখন স্মার্টফোনের মতো। নানা রকম তথ্য লুক্কায়িত থাকে ব্যবহৃত গাড়িতে, এযেন ঠিক চাকাওয়ালা স্মার্টফোন-ই। কারণ ইন্টারনেট-সংযুক্তি এবং ডেটা সংগ্রহের অগণিত পদ্ধতি রয়েছে গাড়িতে। রয়েছে ক্যামেরা। শুধু তাই নয় সিটের ওজন সেন্সর করা, কতটা জোরে ব্রেক কষা হয়েছে সবই জানা যায়।
Mozilla-র তরফে গোপনীয়তা বিষয়ে গবেষণা করেন জেন ক্যালট্রিডার। ২৫টিরও বেশি ব্র্যান্ডের গাড়ির গোপনীয়তা নীতি পর্যালোচনা করেছেন তিনি। জেন বলেন, একটি গাড়ি সংঘটিত যৌন কার্যকলাপ সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
আসলে গাড়িকে ব্যক্তিগত মনে করে ফেলার কোনও কারণই নেই। গাড়ি সংস্থাগুলি গ্রাহকদের ডেটা ব্যবহার করছে এবং অন্যের সঙ্গে শেয়ার করছে, বিশেষত বিমা সংস্থাগুলির সঙ্গে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গোপনীয়তা নিয়ন্ত্রক।
আসলে গাড়ির মালিক কোথায় গাড়ি পার্ক করেছেন তা বোঝার জন্যই ট্র্যাকিং ব্যবস্থা রাখা। তাছাড়া গাড়ি চুরি হলেও বোঝা যেতে পারে কোথায় যাচ্ছে চোরাই গাড়ি। কিন্তু সেই আশীর্বাদী ব্যবস্থাই অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে কারও ক্ষেত্রে। বিশেষত গার্হস্থ্য হিংসার ক্ষেত্রে এটা বড় বিষয়।
২০২০ সালে সানফ্রান্সিসকোর এক মহিলাও এমন দাবি করেছিলেন। তাঁর বিচ্ছিন্ন স্বামী দূর নিয়ন্ত্রিত ভাবে তাঁর গাড়ির শীতলতা বাড়িয়ে দিতেন শীতকালে। এমনকী তাঁর নতুন বাড়ির ঠিকানাও জেনে গিয়েছিলেন। আদালতে গিয়েও ফল পাননি ওই মহিলা, শুধুমাত্র আইনি যুক্তির খাতিরে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দাবি সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ শতাংশ মহিলা কোনও না কোনও ভাবে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তাঁদের সঙ্গীর কাছ থেকে। ৩৮ শতাংশ হত্যাই হয়ে থাকে জীবনসঙ্গীর হাতে। এক্ষেত্রে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ যদি কেউ মাপতে থাকে তাহলে বিপদ আরও বাড়ে।
আমেরিকার ন্যাশনাল ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হটলাইনের চিফ এগজিকিউটিভ কেটি রে-জোনস বলেছেন, গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা যেকোনও সময় ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন মানুষ অন্যজনকে ট্র্যাক করতে এবং হয়রান করতে তাঁর ল্যাপটপ থেকে শুরু করে যেকোনও স্মার্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবহার করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ইন্টারনেট-সংযুক্ত ডিভাইস রয়েছে যার প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে একজন ব্যক্তির গতিবিধির উপর নজর রাখা যায়। সেক্ষেত্রে নতুন আশ্রয় স্থানটি গোপন রাখা মুশকিল হয়ে যেতে পারে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে, মিসেস রে-জোনস বলেন, বাড়ি এবং জিনিসপত্র নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার জন্য সমান অ্যাক্সেস রাখতে হবে প্রথম থেকেই। যদি এমন কোনও অ্যাপ থাকে যা গাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করে তবে তার উপর যেন দু’জনেরই সমান ব্যবহার ক্ষমতা থাকে।
কিন্তু শুধু এটুকুই তো সব নয়। তাই আমেরিকার সাম্প্রতিক ফেডারেল আইনে গার্হস্থ্য নির্যাতনে শিকার ব্যক্তিদের এমন অনুমতি দেওয়া হয়েছে যাতে তাঁরা সেই সব অ্যাকাউন্ট থেকে নিজেদের ফোন সংযোগ ছিন্ন করতে পারেন যার অপব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতে পরিস্থিতি এখনও এতখানি ভয়াবহ নয়, কারণ অধিকাংশ মানুষই স্মার্ট গাড়ি কেনার সুযোগ পাননি এখনও। তাই এখনই সচেতন হওয়ার সময়।