গত শুক্রবার উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়েতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এবং তার আগে মৃতদের করা লাইভ ভিডিও স্তব্ধ করে দিয়েছে গোটা দেশকে। গতি বাড়তে বাড়তে স্পিডোমিটারের কাঁটা পেরিয়ে গিয়েছিল ২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার ঘর। বিএমডব্লিউ গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টোদিক থেকে আস পণ্যবাহী ট্রাকের তলায় ঢুকে দুমড়ে মুচড়ে যায়। পরিস্থিতি এমনই ছিল যে গাড়ির চার যাত্রীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
advertisement
আরও পড়ুন- 'বাথরুমে পরার চপ্পল'-এর দামই প্রায় ৯ হাজার টাকা! নেটিজেনরা ভুল বুঝছেন না তো?
জানা গিয়েছে, বিহারের রোহতাসের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ৩৫ বছর বয়সী অধ্যাপক ড: আনন্দ প্রকাশ সে দিন ছিলেন চালকের আসনে। তাঁর বন্ধুর করা ভিডিও থেকে বোঝা যায় দুর্ঘটনার ঠিক আগে তাঁরা প্রায় ২৩০ কিলোমিটার প্রতিঘণ্টা গতিবেগে গাড়ি ছোটাচ্ছিলেন।
চার বন্ধুর লাইভ ভিডিওতে শোনা গিয়েছে তাঁরা ৩০০ কিলোমিটার প্রতিঘণ্টা বেগে গাড়ি চালাতে চাইছিলেন। সঙ্গে বাজছিল কোনও গান। সে গানই তাঁদের গতি বাড়িয়ে দেবে বলেও দাবি করেছিলেন এক বন্ধু। পাশাপাশি তাঁরা নিজেদের মধ্যে সিটবেল্ট পরে নেওয়ার কথাও বলছিলেন। কিন্তু ২৩০ ছোঁয়ার পরই ভিডিও বন্ধ হয়ে যায়। হয় তো তার পরই উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাকে পিষে যান তাঁরা।
ঘাতক ট্রাকের চালক পলাতক। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে।
সারা ভারতে এমন ঘটনা কিন্তু প্রথম নয়। প্রায় প্রতি বছরই সারা দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে বেপরোয়া গতির বলি হন বহু মানুষ। এই চার বন্ধু তার সাম্প্রতিক সংযোজন মাত্র।
আরও পড়ুন- মাঝ আকাশে যাত্রীর কামড়! জরুরি অবতরণে বাধ্য হলেন বিমানচালক
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় হাই-এন্ড গাড়িগুলিতে ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল মডিউল থাকে যা পরবর্তী সময় ব্রেক ফেলিওর বা কম ব্রেক ফ্লুইডের মতো প্রযুক্তিগত সমস্যা সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে, এই ধরনের ঘটনার পিছনে কারণ নির্ধারণ করতে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে সহায়তা করে।
সাইরাস মিস্ত্রি মার্সিডিজ দুর্ঘটনা
টাটা সনস-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি এবং তাঁর বন্ধু জাহাঙ্গির পান্ডোলেরও সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে এমনই এক দুর্ঘটনায়। পালঘর জেলায় একটি রোড ডিভাইডারে ধাক্কা মারার পর তাঁদের গাড়ি উল্টে যায়। মৃত্যু হয় সাইরাস ও জাহাঙ্গিরের। ওই গাড়ির অন্য দুই গাড়ির আরোহী অনাহিতা পান্ডোল (৫৫), এবং তাঁর স্বামী দারিয়াস পান্ডোল (৬০) জখম হন। তাঁরা মুম্বইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই দুর্ঘটনার তদন্তে দেখা যায় বিলাসবহুল গাড়িটি প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে দৌড়চ্ছিল। দুর্ঘটনা ঘটার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে ব্রেক কষেছিলেন চালক। লাভ হয়নি। তার আগে সাইরাসের মার্সিডিজ গাড়িটি মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার চারটি চেকপোস্ট অতিক্রম করেছিল মাত্র নয় মিনিটে। এর দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। প্রাথমিক তদন্তের পর তদন্তকারী আধিকারিকরা জানিয়েছিলেন মৃত দু’জনের কেউই সিট বেল্ট পরেছিলেন না।
অডি দুর্ঘটনায় ডিএমকে বিধায়কের ছেলের মৃত্যু
গত বছর ডিএমকে বিধায়ক ওয়াই প্রকাশের ছেলে করুণা সাগর এবং অন্য ছ’জন জনের মৃত্যু হয় এমনই এক গাড়ি দুর্ঘটনায়। ২০২১ সালে অডি Q3 গাড়িটি বেঙ্গালুরুর কোরামঙ্গলা এলাকায় একটি বাড়িতে ধাক্কা মেরেছিল। ঘটনাস্থলেই ছ’জনের মৃত্যু হয়। আরোহী একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সাগর ছিলেন ডিএমকে বিধায়ক ওয়াই প্রকাশের ছেলে। তিনি তামিলনাড়ুর হোসার কেন্দ্রের জনপ্রতিনিধিও ছিলেন।
কর্নাটকের মন্ত্রীর ছেলের মার্সিডিজ বেঞ্জ দুর্ঘটনা
২০২০ সালে, কর্ণাটকের রাজস্ব মন্ত্রী আর অশোকের ছেলের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। হোসাপেটের কাছে মরিয়মমানহাল্লিতে ৫০ নম্বর জাতীয় সড়কের ওই দুর্ঘটনায় চার জনের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। সে ক্ষেত্রেও দামি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটি দ্রুত গতিতে চলার সময়ই চালক গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারান। প্রথমে এক পথচারী রবি নায়ককে ধাক্কা দেয় গাড়িটি। ১৮ বছরের রবিকে গাড়িটি কয়েক মিটার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। গাড়ির অন্যতম আরোহী শচীন শেশাইয়াও নিহত হন ওই দুর্ঘটনায়। তদন্তে জানা যায় গাড়িটি বেঙ্গালুরু দক্ষিণের ন্যাশনাল পাবলিক স্কুলের ছিল। ওই স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন রাজ্যের রাজস্ব মন্ত্রী আর অশোক।
দিল্লি বিএমডব্লিউ দুর্ঘটনা
পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেসওয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাটি দিল্লির লাল কেল্লার কাছে রিং রোডে ঘটেছে। গত ৬ অগাস্ট রাত ১১টা নাগাদ একটি দ্রুতগামী বিএমডব্লিউ গাড়ি গীতা কলোনি থেকে রাজঘাট যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটি গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষের পরে উল্টে যায়। পাঁচজন জখম হন।
পশ্চিমবঙ্গের ফেরারি দুর্ঘটনা
২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার ডোমজুড়ে দ্রুতগতির ফেরারি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তরুণ বাঙালি ব্যবসায়ী শিবাজি রায়ের। ৪৩ বছরের ওই ব্যবসায়ী তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে রবিবারের সকালে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর তাঁর দ্রুতগতি গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারায়।
ত্রিশূর থার, বিএমডব্লিউ রেস দুর্ঘটনা
কেরলের ত্রিশুর জেলার কোটেক্কাদ এলাকায় একটি মাহিন্দ্রা থর এবং একটি বিএমডব্লিউ-এর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। গত জুলাই মাসে সেই দুর্ঘটনায় একজন নিহত হন। নিহতের স্ত্রী, মেয়ে ও নাতনির পাশাপাশি ট্যাক্সি চালকও আহত হয়েছেন।
পন্টি চাড্ডার ভাইপোর দুর্ঘটনা
২০১৯ সালে দিল্লির চাণক্যপুরী এলাকায় মদ ব্যবসায়ী পন্টি চাড্ডার ভাইপো আশিস সিং চাড্ডার দামি বেন্টলি গাড়ি একটি অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে একজন মারা যান। তুর্কমেনিস্তানের তিনজন মহিলা যাত্রী আহত হন। পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বলেছেন যে গাড়ির চালক মাতাল ছিলেন না এবং যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩০৪এ (অবহেলায় মৃত্যু ঘটানো) এর অধীনে একটি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ৪২৬ জন বা প্রতি এক ঘণ্টায় সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ জনের প্রাণহানি হয়। যে কোনও ক্যালেন্ডার বছরে এ পর্যন্ত এই ধরনের দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছে।
তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৫৯.৭ শতাংশ অতিরিক্ত গতির কারণেই ঘটে থাকে।