ভারতে প্রথম এই ধরনের উদ্যোগ। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর শ্রী অনন্ত আম্বানির তত্ত্বাবধানেই মূলত এই উদ্যোগের জন্ম। প্রসঙ্গত, অনন্ত আম্বানি জামনগরে রিলায়েন্সের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবসারও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর সেক্ষেত্রে ২০৩৫ সালের মধ্যে রিলায়েন্স নেট কার্বন জিরো কোম্পানি হয়ে উঠতে পারবে।
স্বাস্থ্য পরিষেবা, হাসপাতাল, রিসার্চ এবং অ্যাকাডেমিক সেন্টারের মতো সেরা গুণমানসম্পন্ন প্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রাণীদের যত্নের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে Vantara। এর পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএম) এবং প্রকৃতির জন্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ)-এর মতো স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থার সঙ্গে উন্নত গবেষণা ও সহযোগিতাকে একীভূত করার দিকেও মনোনিবেশ করে Vantara। আর এটাও তাদের প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত।
advertisement
গত কয়েক বছরে এই কর্মসূচির মাধ্যমে ২০০টিরও বেশি হাতি এবং কয়েক হাজার অন্যান্য প্রাণী, সরীসৃপ ও পাখিকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গন্ডার, চিতাবাঘ এবং কুমিরের মতো মূল প্রজাতির পুনর্বাসনের উদ্যোগও গ্রহণ করেছে।
এছাড়া মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা ইত্যাদির মতো দেশেও উদ্ধারাভিযানে অংশগ্রহণ করেছে Vantara। সম্প্রতি সেন্ট্রাল আমেরিকান চিড়িয়ানা কর্তৃপক্ষের ডাকে একাধিক বড় পশু এনেছে তারা। ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অধীনেই এই ধরনের সমস্ত উদ্ধার এবং পুনর্বাসন অভিযান গ্রহণ করা হয়েছে।
ওই অনুষ্ঠানে শ্রী অনন্ত আম্বানি বলেন, “ছোটবেলায় বন ও বন্যপ্রাণ আমার লাগার বিষয় ছিল। আর সেটাই এখন বনতারা এবং আমাদের দুর্দান্ত ও অঙ্গীকারবদ্ধ টিমের সঙ্গে মিলে একটা লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা ভারতের স্থানীয় বিপন্ন প্রজাতিগুলিকে রক্ষা করার দিকে মনোনিবেশ করছি। আমরা গুরুত্বপূর্ণ বাসস্থান পুনরুদ্ধার এবং প্রজাতিগুলির জন্য জরুরি হুমকি মোকাবিলা করতে চাই। সেই সঙ্গে বনতারাকে একটা অন্যতম প্রধান সংরক্ষণ প্রোগ্রাম হিসেবে গড়ে তুলছে চাইছি। আমাদের এই প্রয়াস যে ভারতে এবং বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে, তার জন্য আমরা যারপরনাই আনন্দিত। আমাদের এই মিশনে যোগ দিয়েছেন ভারত তথা বিশ্বের সেরা প্রাণিবিদ্যা এবং মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞরা। আর সরকার, গবেষণা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কাছ থেকে সক্রিয় সহযোগিতা এবং নির্দেশিকা পাওয়ায় আমরা ধন্য। প্রশিক্ষণ, ক্ষমতা তৈরি এবং পশুদের যত্নের পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে দেশের দেড়শোটিরও বেশি চিড়িয়াখানার অবস্থার উন্নতি করার জন্য জ্যু অথরিটি অফ ইন্ডিয়া এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করাও বনতারার অন্যতম লক্ষ্য। আমাদের আশা, বনতারা বিশ্বব্যাপী আশার আলো হয়ে উঠবে। আর কীভাবে একটি অগ্রসর চিন্তাশীল প্রতিষ্ঠান বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ উদ্যোগে সাহায্য করতে পারে, সেটাও প্রদর্শন করবে এটি।”
Vantara প্রতিষ্ঠার পিছনে যে তত্ত্ব রয়েছে, তা ব্যাখ্যা করে অনন্ত আম্বানি বলেন, “বনতারা হল সমবেদনার বহু-প্রাচীন নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত পেশাদারিত্বের সংমিশ্রণ। জীব সেবাকে আমি সর্বশক্তিমান তথা মানবতার সেবা হিসেবে দেখি।” বনতারায় হাতিদের জন্য একটি কেন্দ্র রয়েছে। এর পাশাপাশি সিংহ, বাঘ, কুমির, লেপার্ড-সহ অন্যান্য বড় এবং ছোট প্রজাতির জন্যও সুবিধা রয়েছে এখানে।
হস্তী কেন্দ্র:
বনতারায় হাতিদের জন্য যে কেন্দ্রটি রয়েছে, সেটি ৩০০০ একর প্রাঙ্গণের একটি বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত। অত্যাধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র, বৈজ্ঞানিক ভাবে ডিজাইন করা দিন ও রাতের এনক্লোজার, হাইড্রোথেরাপি পুল, জলাশয় এবং হাতিদের আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসার জন্য একটি বড় এলিফ্যান্ট জ্যাকুজিও রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় ২০০টিরও বেশি হাতি। সেখানে বিশেষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মীদের দ্বারা চলে সার্বক্ষণিক পরিচর্যাও। এই কাজের জন্য নিযুক্ত রয়েছেন পশুচিকিৎসক, জীববিজ্ঞানী, প্যাথলজিস্ট, পুষ্টিবিদ এবং প্রকৃতিবিদ-সহ প্রায় ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ।
এই কেন্দ্রে রয়েছে প্রায় ২৫০০০ বর্গফুটের একটি হাতিদের হাসপাতাল। যা বিশ্বে সর্ববৃহৎ। হাসপাতালে রয়েছে চিকিৎসার জন্য পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন, লেজার মেশিন, ফার্মেসি, সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য প্যাথলজি, ইম্পোর্টেড এনলিফ্যান্ট রেস্ট্রেইনিং ডিভাইস, হাইড্রোলিক পুলি ও ক্রেন, হাইড্রোলিক সার্জিক্যাল টেবিল এবং হাইপারবারিক অক্সিজেন চেম্বারও। ক্যাটারাক্ট এবং এন্ডোস্কোপিক গাইডেড সার্জারিও করা হয় হাসপাতালে। আর সবথেকে বড় কথা হল, যে কোনও জরুরি অস্ত্রোপচার হয় এখানে।
এছাড়া ওই কেন্দ্রে ১৪০০০ বর্গফুটের একটি বিশেষ রান্নাঘরও রয়েছে। যেখানে হাতিদের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে খাবার প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে এখানে হাতিদের উপর আয়ুর্বেদিক কৌশলও প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হল মুলতানি মাটি থেকে শুরু করে গরম তেল ম্যাসাজ। এর জন্য কাজ করে চলেছেন আয়ুর্বেদ অনুশীলনকারীরাও।
উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র:
সার্কাস বা ভিড়যুক্ত চিড়িয়াখানায় থাকা অন্যান্য বন্য প্রাণীদের জন্য একটি একটি উদ্ধার এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রও তৈরি করা হয়েছে। ৩০০০ একর জায়গার মধ্যে এটি ৬৫০ একর জায়গা নিয়ে তৈরি। যেখানে ভারত তথা সারা বিশ্ব থেকে বিপর্যস্ত এবং বিপজ্জনক পরিবেশের প্রাণী উদ্ধার করে আনা হয়। আর তাদের অত্যাধুনিক বড় এনক্লোজার এবং আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়।
প্রায় ২১০০ জনেরও বেশি কর্মী নিয়ে তৈরি উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এখনও পর্যন্ত সারা ভারত থেকে উদ্ধার করেছে প্রায় ২০০টি লেপার্ড। এই লেপার্ডগুলি সড়ক দুর্ঘটনায় কিংবা মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাতে জখম হয়েছে। আবার তামিলনাড়ু থেকে উদ্ধার হয়েছে ১০০০টিরও বেশি কুমির। এছাড়া আফ্রিকার হান্টিং লজ ও স্লোভাকিয়ায় ইউথ্যানেশিয়ার বিপদের মুখে পড়া প্রাণী, এমনকী মেক্সিকো থেকে মারাত্মক যন্ত্রণার মধ্যে থাকা প্রাণীদের উদ্ধার করা হয়েছে।
ওই কেন্দ্রে রয়েছে একটি ১ লক্ষ বর্গফুট হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার। হাসপাতাল এবং গবেষণা কেন্দ্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-সহ রয়েছে একটি আইসিইউ, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড, এন্ডোস্কোপি, ডেন্টাল স্কেলার, লিথোট্রিপসি, ডায়ালাইসিস, ওআর১ প্রযুক্তি। যা সার্জারি এবং ব্লাড প্লাজমা সেপারেটরের জন্য লাইভ ভিডিও কনফারেন্স এনেবল করে।
ওই উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে রয়েছে মোট ৪৩টি প্রজাতির ২০০০-এরও বেশি প্রাণী। বিদেশি প্রাণী থেকে শুরু করে ভারতীয় বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সংরক্ষণের কাজও শুরু করেছে কেন্দ্রটি। এর জন্য প্রজনন করানো হচ্ছে। আজকের দিনে বনতারা ইকোসিস্টেম প্রায় দু’শোটিরও বেশি হাতি এবং লেপার্ড, বাঘ, সিংহ, জাগুয়ার ইত্যাদির মতো পশুদেরকে জীবন এবং আশার আলো দিয়েছে। এর পাশাপাশি প্রায় তিনশোটিরও বেশি হরিণের তৃণভোজী এবং কুমির, সাপ এবং কচ্ছপের মতো প্রায় ১২০০টিরও বেশি সরীসৃপকেও আশার আলো দেখিয়েছে ওই কেন্দ্র।
উদ্ধার এবং আদানপ্রদানের সম্মতি:
১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইন এবং ২০০৯ সালের রেকগনিশন জ্যু রুলের আওতায় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের চিফ ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন এবং সেন্ট্রাল জ্যু অথরিটির অনুমতি নিয়ে উদ্ধার করা পশুদের বনতারায় আনা হয়। সমস্ত প্রাণী বিনিময় প্রোগ্রাম কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা থেকে অনুমোদন বা অনুমতি নিয়েই করা হয়। সেন্ট্রাল জ্যু অথরিটি, মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্য়ান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ, ডিরেক্টোরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড, ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি অ্যান্ড ডেয়ারিং এবং ওয়াল্ড ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর থেকে অনুমতি নিয়ে তবেই এই ধরনের প্রাণীদের আনা হয়।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:
ভেনেজুয়েলান ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন অফ জ্যু-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে দারুণ কৃতিত্ব অর্জন করেছে বনতারা প্রোগ্রাম। এর পাশাপাশি এটি স্মিথোসোনিয়ান এবং ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ জ্যুস অ্যান্ড অ্যাকোয়ারিয়ামসের মতো নামীদামি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত। আবার ভারতে তারা কোল্যাবোরেট করেছে ন্যাশনাল জ্যুলজিক্যাল পার্ক, অসম রাজ্য চিড়িয়াখানা, নাগাল্যান্ড জ্যুলজিক্যাল পার্ক, সর্দার প্যাটেল জ্যুলজিক্যাল পার্ক ইত্যাদির সঙ্গেও।
শিক্ষা এবং সচেতনতা:
মানুষ বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায় এবং শিশুদের মধ্যে সংরক্ষণ বিষয়ক সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গেও গাঁটছড়া বেঁধেছে বনতারা উদ্যোগ। আধুনিক ও ভবিষ্যৎ, জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত এনক্লোজারে কিছু প্রাণীর জন্য ডিসপ্লে এরিয়া তৈরি করারও ধারণা দেয় Vantara। যা যত্ন এবং সহানুভূতির ক্ষেত্রে এক নতুন মানদণ্ড তৈরি করছে।
সবুজ এলাকা:
সবুজায়নের উদ্যোগের পাশাপাশি একসঙ্গে চলতে থাকবে পশু সংরক্ষণ এবং উদ্ধারাভিযানও। রিলায়েন্স রিফাইনারি এলাকার সবুজায়নের লক্ষ্য চালিয়ে যাবে Vantara প্রোগ্রাম। ইতিমধ্যে অবশ্য কয়েক হাজার একর জমির সবুজায়নও সম্পন্ন হয়েছে।