শীতকালে কেন অ্যাজমার অবস্থার আরও অবনতি ঘটে?
অ্যাজমা হল মুখ্য ননকমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি)। এটা যে শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা দেয়, এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। শিশুদেরও অ্যাজমার সমস্যা হতে পারে। আবার শিশুদের ক্ষেত্রে কিন্তু এটা সবথেকে সাধারণ ক্রনিক ফুসফুসের রোগ। এই রোগের ক্ষেত্রে আসলে কী হয়। এটি এমন একটি অবস্থা, যার জেরে শ্বাসনালী ফুলে ওঠে এবং তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত পরিমাণে মিউকাসও তৈরি করে। আর এই সব কিছু মিলিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াটা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে।
advertisement
মরশুম বদলের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাজমায় আক্রান্ত রোগীদের কিছু বিষয়ের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে হয়। যার মধ্যে অন্যতম হল তাপমাত্রার ওঠা-নামা। এর পাশাপাশি পরিবেশে কিছু নতুন ইরিট্যান্টও চলে আসে। যা শ্বাসজনিত সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
তাই এই অবস্থায় শ্বাসনালী ঠান্ডা ও শুষ্ক হাওয়ার সংস্পর্শে আসে এবং এর সঙ্গে শীতকালীন ট্রিগারগুলির সম্মুখীন হয়। আর এই কারণেই শ্বাসনালীর পেশিতে স্প্যাজম দেখা দেয়। কিন্তু শ্বাসনালী সেই অবস্থাতেও খোলা থাকার চেষ্টা করে। ফলে ফুসফুসে একটা বিপরীতমুখী চাপের সৃষ্টি হয়। আর এই প্রক্রিয়ার জেরেই অ্যাজমার নানা উপসর্গ প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। প্রসঙ্গত অ্যাজমার উপসর্গের মধ্যে অন্যতম হল কাশি, শ্বাস নেওয়ার সময় সাঁ সাঁ করে আওয়াজ, শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ অনুভূতি ইত্যাদি। এই সব কারণেই মূলত অ্যাজমার অ্যাটাক ঘটে।
যাঁদের আগে থেকে অ্যাজমা রয়েছে, তাঁদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এই বিষয়টা। শুধু তা-ই নয়, আবহাওয়ার জন্য যাঁদের নতুন করে হাঁপানির রোগ ধরেছে, তাঁদের জন্যও এই বিষয়টা সমান ভাবে বিপজ্জনক। কারণ ঠান্ডা হাওয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করার ফলে শ্বাসনালীতে হিস্টামিন তৈরি হয়। আর এই হিস্টামিন হল সেই রাসায়নিক, যা অ্যালার্জি অ্যাটাকের ক্ষেত্রে আমাদের শরীরে তৈরি হয়।
অ্যাজমার ট্রিগার, যেগুলি শীতকালে খুবই বেড়ে যায়:
আমরা যে শ্বাসপ্রশ্বাস নিই, তার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা খুবই কঠিন। আসলে আমাদের পারিপার্শ্বিক অংশের বাতাস বিভিন্ন মরশুমে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আর শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাজমার কিছু ট্রিগারও নিয়ে আসে। যার মধ্যে খুবই সাধারণ ট্রিগার হল ঠান্ডা হাওয়া। আর এই সব ট্রিগারের কারণে অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ে। যেখানে ফুসফুসে প্রদাহ শুরু হয়। এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার সঙ্গী হয়ে আসে ব্রঙ্কোস্প্যাজমও (শ্বাসনালী দ্রুত এবং আচমকা সংকীর্ণ হয়ে যায়)।
ঠান্ডা হাওয়ার পাশাপাশি শীতকালীন অন্যান্য ট্রিগারগুলির মধ্যে রয়েছে পোলেন বা ফুলের রেণু, মল্ড, স্যাঁতস্যাঁতে ভাব এবং ধুলোর কণা। যা বুকের সংক্রমণের পাশাপাশি সাধারণ ঠান্ডা এবং ফ্লুয়ের ভাইরাসের সংস্পর্শে আসে। আসলে মরশুমি ফ্লু এমনিতে শীতকালে খুবই সাধারণ বিষয় হলেও এটা কিন্তু সব থেকে গুরুতর ট্রিগার। যা অ্যাজমার উপসর্গগুলিকে আরও প্রকট করে তোলে। অ্যাজমায় আক্রান্ত রোগী যদি ঠান্ডা এবং ফ্লু ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেন, তখন তাঁর সংক্রমণ নিউমোনিয়ায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তাই এই সব ট্রিগার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং নিজের সম্ভাব্য ট্রিগার সনাক্ত করতে হবে। যাতে চিকিৎসকের কাছে এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলা যায়। যাতে সঠিক চিকিৎসা হতে পারে। আর রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতাও অবলম্বন করা যায়।
কোন কোন উপসর্গের উপর নজর রাখতে হবে?
অ্যাজমা বা হাঁপানির মতো সমস্যার উপসর্গ বিভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে আলাদাই। তাই শীতের মরশুমে কয়েকটি উপসর্গের উপর নজর রাখতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হল শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ চাপ ভাব অথবা বুকে ব্যথা, কাশি এবং শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার সময় সাঁ সাঁ আওয়াজ। আবার অ্যাজমায় আক্রান্ত কিছু রোগীর ক্ষেত্রে আবার কাশি, নাক বন্ধ হয়ে আসা, নাক দিয়ে জল গড়ানো, গলা ব্যথা এবং মিউকাস জমাট বাঁধার মতো লক্ষণ দেখা যায়। শীতকালে এই সব অ্যাজমা ট্রিগারের উপরেও নজর রাখা দরকার। এর পাশাপাশি ফ্লুয়ের মতো সংক্রমণও কিন্তু অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে খানিকটা বোঝার মতো কাজ করে। এই ধরনের উপসর্গ প্রকাশ পেলে দেরি না-করেই ডাক্তারের কাছে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।
শীতের মরশুমে অ্যাজমা উপসর্গের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যাজমা রোগীদের ইনহেলার কীভাবে সাহায্য করে?
ইনহেলার আসলে অ্যাজমার অত্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা। দুর্দান্ত ভাবে অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি তা এই রোগের উপসর্গের প্রভাব খর্ব করার জন্য খুবই কার্যকর।
আসলে ইনহেলার এমন একটা জিনিস, যা ফুসফুসে সরাসরি ভাবে ওষুধ পৌঁছে দেয়। যা শ্বাসনালীকে শিথিল করতে সাহায্য করে এবং রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণেও কোনও সমস্যা থাকে না।
ছোট ছোট এবং পরিমিত পরিমাণ ডোজ সরাসরি শ্বাসনালিতে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে ইনহেলার। ফলে ডোজও কম লাগে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যায়।
প্রতিরোধ এবং তাৎক্ষণিক আরামের মাধ্যমে অ্যাজমার উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে ইনহেলার। যা রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
ইনহেলার কিন্তু সমস্ত বয়সের মানুষের জন্যই উপযোগী। তবে একটা বিষয় সব সময় মাথায় রাখতে হবে। আর সেটা হল, ইনহেলার কিন্তু ব্যবহার করতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।
আরও পড়ুন- সংক্রান্তির পরেই শনিদেবের গোচরে ঘুরতে চলেছে ভাগ্যের চাকা, আপনার কপালে কী আছে?
শিশুদের ক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহার করার বিষয়ে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে। আর সেটা হল - ইনহেলারের সঙ্গে সঙ্গে একটা স্পেসার ডিভাইস ব্যবহার করা উচিত।
ঠান্ডা আবহাওয়ায় কার্যকর ভাবে কী করে এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
এই অবস্থা প্রতিরোধ করার প্রথম পদক্ষেপই হল সম্ভাব্য ট্রিগারগুলিকে সনাক্ত করা এবং তা প্রতিরোধ করার উপায় খোঁজা। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করণীয় বিষয়গুলি ঠিক করে ফেলতে হবে। কারণ এটা অন্যতম জরুরি বিষয়। এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যানের মধ্যে রয়েছে রেসকিউ মেডিসিনের কম্বিনেশন। যা তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদী আরাম এবং মেনটেনেন্স মেডিকেশনের সময় নিতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদিন এই ওষুধ খেতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট প্ল্যান মেনে চলতে হবে এবং তার পরেও যদি উপসর্গে কোনও এ-দিক ও-দিক হয়, সেটাও ডাক্তারবাবুকে জানাতে হবে। এই বিষয়টাও রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ডাক্তারের পরামর্শ মেনে একটি রেসকিউ ইনহেলারও ব্যবহার করতে হবে। নাম থেকেই এটা স্পষ্ট যে, এই অবস্থা যাতে বেড়ে না-যায়, তা থেকে মুক্তি দিতে পারে ইনহেলার।
এর পাশাপাশি আরও কিছু সতর্কতা মূলক পদক্ষেপ অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়:
ভ্যাকসিনেশন জরুরি:
নিয়মিত ভ্যাকসিনেশনের পাশাপাশি বার্ষিক ফ্লু ভ্যাকসিনেশনও কিন্তু জরুরি। এটা আসলে শ্বাসনালীতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ করে তুলতে পারে।
ঘরে থাকতে হবে:
যে সময়টায় তাপমাত্রা আচমকা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কমে যায়, সেই সময়টায় ঘরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মধ্য রাত অথবা ভোরের দিকটায় ঘরে থাকতে হবে।
মাস্ক পরা বাঞ্ছনীয়:
শ্বাসনালীতে যাতে সরাসরি ভাবে ঠান্ডা এবং শুষ্ক বাতাস না-পৌঁছতে পারে, তার জন্য মাস্ক পরতে হবে। আসলে মাস্ক এই বিষয়টাকে প্রতিরোধ করে।
উষ্ণ তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে:
ঠান্ডা এবং শুষ্ক হাওয়ার কারণে শ্বাসনালীর ভিতরটা শুষ্ক হয়ে ওঠে। যার ফলে অস্বস্তির কারণে অতিরিক্ত মিউকাস উৎপন্ন হয়। তাই এই সময়টায় গরম-গরম তরলজাতীয় খাবার খেলে মিউকাস শরীর থেকে নির্গত হতে পারে এবং শ্বাসনালীও পিচ্ছিল হয়ে যায়।
ঘর-বাড়ি ধুলো মুক্ত করতে হবে:
অ্যালার্জি দূর করার জন্য ঘর-বাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে। ঘরের ভিতরের অংশকে ধুলোবালি মুক্ত করার জন্য মাঝেমধ্যেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
সঠিক খাওয়াদাওয়া:
অ্যাজমার উপর সঠিক ডায়েটের একটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। শীতের মরশুমে অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ ডায়েট। শীতে অ্যাজমার রোগীদের বেশি পরিমাণে আদা এবং রসুন খাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দুই সবজির মধ্যেই রয়এছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান।
হাইজিন বজায় রাখতে হবে:
ঠান্ডা লাগা অথবা সংক্রমণ এবং ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রুখতে হাইজিন বজায় রাখাটাও জরুরি। হাইজিনের জন্য মাঝেমধ্যেই সাবান এবং জল দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।