শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি জঙ্গলের নৈসর্গিক পরিবেশে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় হীরালিনী দুর্গোৎসব। এই পুজো অন্য সব দুর্গোৎসবের থেকে একেবারেই আলাদা। নেই প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ, বলি প্রথা কিংবা বাণিজ্যিক থিম। নেই ঝলমলে আলোকসজ্জা বা বিজ্ঞাপনী তোরণও। কেবল প্রকৃতির কোলে, জঙ্গলের সবুজে ঘেরা পরিবেশে শৈল্পিক প্রতিমাই হয়ে ওঠে এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ।
আরও পড়ুন: বসিরহাটের ‘এই’ পুজো মণ্ডপে গেলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবেন নচিকেতা, কী এমন আয়োজন করলেন উদ্যোক্তারা
advertisement
এবার বীরভূমের এই অনন্য উৎসব পা দিল ২৫ বছরে। বিশেষ এই উপলক্ষে শিল্পী আশিষ ঘোষ, যিনি বর্তমানে এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা, কাঠ খোদাই করে নির্মাণ করছেন এক অপূর্ব প্রতিমা। মাত্র তিন খণ্ড কাঠ দিয়ে তৈরি হচ্ছে সমগ্র প্রতিমা—আম কাঠে দুর্গা, মহিষাসুর ও হিংস, আর গামার কাঠে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক ও সরস্বতী। প্রতিমার অলঙ্কারও খোদাই করা কাঠেরই, যেখানে ফুটে উঠছে নিপুণ শৈল্পিকতার ছাপ। সাড়ে তিন মাস ধরে চলছে এই নির্মাণকাজ।
আরও পড়ুন: বাংলা ভাষা নিয়ে হাজার বিতর্ক! এরই মাঝে এবার নদিয়ায় আলাদা রূপে পূজিতা হবেন ‘বড়মা’, পুজোয় থাকছে বড় চমক
হীরালিনী দুর্গোৎসবের সূচনা হয়েছিল ২০০১ সালে, শিল্পী বাঁধন দাসের হাত ধরে। ২০০২ সালে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের বিভীষিকায় (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বংস, ইরাক যুদ্ধ) তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আর কোনওদিন দুর্গার হাতে অস্ত্র থাকবে না। তার বদলে থাকবে পদ্মফুল, যা বিশ্বশান্তির বার্তা বহন করে। সেই বছরই শিল্পী বাঁধন দাসের প্রয়াণ ঘটে। তারপর থেকে তাঁর ছাত্র আশিষ ঘোষ এই পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন এবং আজও সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
হীরালিনী দুর্গোৎসবকে ঘিরে সোনাঝুরি জঙ্গলসংলগ্ন আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলো—বনেরপুকুর ডাঙা, সরপুকুর ডাঙা, বল্লভপুর ডাঙা, ফুলডাঙা প্রভৃতি গ্রামের মানুষজন একত্রিত হন। প্রতিমা গড়া থেকে শুরু করে চার দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন পর্যন্ত সবকিছুই তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে সম্পন্ন হয়। এই সময় আদিবাসী সম্প্রদায়ের বেলবরণ উৎসবও পালিত হয়, ফলে জঙ্গলের মাঝে গড়ে ওঠে এক বিশেষ লোক-সংস্কৃতির মঞ্চ। প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড থেকেও বহু মানুষ এই উৎসবে যোগ দেন এবং কয়েকদিন এখানে থেকে আনন্দ ভাগ করে নেন।
সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত সোনাঝুরির জঙ্গলে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে। প্রতিমা দর্শন, সেলফি তোলা, লোকনৃত্য ও লোকগান উপভোগ করতে মানুষজন ভিড় জমানোকে উৎসবে পরিণত করে তোলে। হীরালিনী দুর্গোৎসব তাই কেবল একটি পুজো নয়, এটি শিল্প, প্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির মিলিত এক উৎসব, যা শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।