যে কোনও আলোচনার মাঝে যদি একবার “ডায়াবেটিস” শব্দটি উচ্চারিতহয়, তাহলে কথোপকথনের বাকি অংশে শুনতে পাবেন-খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কিত বিধিনিষেধ, কার্ব মেপে খাওয়া, ডায়াবেটোলজিস্টের সাথে পরামর্শ সম্পর্কিত কিছু কথা এবং বাড়িতে ব্লাড সুগার মাপার নতুন কী যন্ত্রপাতি বেরিয়েছে। কিন্তু ডায়াবেটিসের কারণে আপনার চোখের কতটা ক্ষতি হতে পারে, সেই বিষয়ে খুব একটা কথা কেউই বলবেন না। এমনকী ডায়াবেটিসের কারণে চোখের উপরে কী প্রভাব পড়ে সেই সম্পর্কে বহু মিথ বা ভুল ধারণা রয়েছে।
advertisement
এই ভুল ধারণাগুলি ভাঙার জন্য এবং ডায়াবেটিস রোগীরা যাতে নিজেদের স্বাস্থ্য ও দৃষ্টিশক্তির যত্ন নিতে পারেন, তার জন্য Novartis-এর সহযোগিতায় Network18 চালু করেছে 'Netra Suraksha' - India Against Diabetes initiative নামের একটি উদ্যোগ। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে Network18সম্প্রচার করবে চিকিৎসা জগতের সাথে যুক্ত প্রতিনিধিদের নিয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক।এছাড়াও প্রকাশ করা হবে ব্যাখ্যামূলক ভিডিও এবং প্রতিবেদন, যাতে ডায়াবেটিস, দৃষ্টিশক্তির উপরে এর প্রভাব, এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো রোগ সম্পর্কেসাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতাছড়িয়ে দেওয়া যায়।অনেকেই জানেন না যে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক মানুষই এই রোগের শিকার হন1।
তাহলে আসুন সঠিক তথ্যগুলি জেনে নেওয়া যাক।
মিথ1: যত ক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, তত ক্ষণ চোখ ভালো আছে।
দেখতে যদি কোনও সমস্যা না হয়, তাহলে খুবই ভালো কথা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে চোখ সুস্থ রয়েছে। অধিকাংশ রোগের ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে খুব কম বা কোনও উপসর্গই থাকে না।
গ্লুকোমাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরবে দৃষ্টি হরণকারী রোগ বলা হয়, কারণ এক্ষেত্রে এমন কোনও উপসর্গ বোঝা যায় না, যা দেখে আপনি সতর্ক হতে পারেন। চোখের পিছনের অংশে থাকা যে অপ্টিক নার্ভ মূলত গ্লুকোমার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলি মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত থাকে2। গ্লুকোমার নিরাময় সম্ভব নয়, তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এর চিকিৎসা সম্ভব। সঠিক চিকিৎসা না হলে. গ্লুকোমার কারণে দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারাতে পারেন।
ছানি বা ক্যাটারাক্ট হচ্ছে আপনার চোখের লেন্স অংশে গড়ে ওঠা ধোঁয়াটে আচ্ছাদন। বহু বছর ধরে চোখে অল্প অল্প করে ছানি পড়তে পারে, কিন্তু সেগুলি পেকে না যাওয়া পর্যন্ত দেখতে কোনও সমস্যা হয় না। তাই এই রোগ জটিল পর্যায়ে চলে গেলে, সার্জারি করার প্রয়োজন হয়3।
ডায়াবেটিস সম্পর্কিত সবচেয়ে পরিচিত চোখের রোগ হল ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। এই রোগের ক্ষেত্রে, চোখে (বিশেষ করে রেটিনা অংশে) রক্ত সরবরাহকারী রক্তজালিকাগুলি ব্লক হয়ে যেতে বা লিক করতে কিংবা ফেটে যেতে পারে4।প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগের কোনও উপসর্গ বোঝা যায় না, কিন্তু রোগ যখন জটিল হতে শুরু করে, তখন পড়তে অসুবিধা হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয় এবং এই সমস্যা চশমা বদলানোর পরেও ঠিকহয় না। সঠিক সময়ে ধরা না পড়লে, এই রোগের কারণে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে পারে4।
মিথ 2: যাঁদের ডায়াবেটিস হাই নয়, তাঁদের চোখে সমস্যার ঝুঁকি অনেক কম।
পরিসংখ্যান মিথ্যা হয় না। সারা বিশ্বে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগকে কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি হারানোর অন্যতম প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হয়।5ভারতে 2025 সালের মধ্যে ডায়াবেটিস মেলিটাস-এ আক্রান্ত অন্তত 57 মিলিয়ন নাগরিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে5।
পজিটিভ ভাবনা-চিন্তা করা অবশ্যই ভালো, কিন্তু ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করা কখনোই ভালো নয়। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হল ডায়াবেটিসের কারণে হওয়া অত্যন্ত জটিল ও খুব পরিচিত একটি সমস্যা। যত বেশি সময় শরীরে ডায়াবেটিস রয়েছে, এই জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তত বেশি।
মিথ 3: শুধুমাত্র টাইপ 1 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি-র ঝুঁকি বেশি।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত যে কোনও ব্যক্তির ডায়াবেটিক চোখের রোগ হতে পারে, এই ধরনের রোগ টাইপ1 এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিসের মধ্যে কোনও ভেদাভদ করে না। কোনও অন্তঃসত্ত্বা মহিলা যদি জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, তাহলে তাঁর ক্ষেত্রেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আগামী দুই দশকের মধ্যে টাইপ 1 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় প্রত্যেক রোগী এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে >60% রেটিনোপ্যাথি-তে আক্রান্ত হবেন6।
নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করালে আপনার চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহজেই এই রোগ চিহ্নিত করতে এবং তার চিকিৎসা দ্রুত শুরু করতে পারবেন।
মিথ4: আমার সদ্য ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, তাই আমার চোখ পরীক্ষা করানোর দরকার নেই।
এটা ঠিক যে ডায়াবেটিসে দীর্ঘ সময় ধরে আক্রান্ত থাকলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, অন্তত পরিসংখ্যান সেই কথাই বলে। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঝুঁকি পৃথক হয়। প্রত্যেকের শরীর আলাদা এবং সামগ্রিক ভাবে অনেকের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম ভেবে নিজের চোখকে অবহেলা করবেন না। কারণ, হতেই পারে আপনার শরীরের ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেশি।
হ্যাঁ, টাইপ 1 ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে প্রথম 3–5 বছরের মধ্যে দৃষ্টি-হরণকারী রেটিনোপ্যাথি-তে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ খুবই বিরল। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে টাইপ 1 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় প্রত্যেক রোগী রেটিনোপ্যাথি-তে আক্রান্ত হবেন।
কিন্তু, প্রায় 21% টাইপ 2 ডায়াবেটিসে রোগীর ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয়ের সময়েই দেখা গিয়েছে যে তাঁরা রেটিনোপ্যাথি-তে আক্রান্ত6!
মিথ 5: যাঁদের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয় তাঁরা অন্ধ হয়ে যান।
না। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এটা কখনোই হবে না। যত দ্রুত চিকিৎসক এই রোগ নির্ণয় করবেন, আপনার পক্ষে তত ভালো। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হল এক ধরনের প্রোগ্রেসিভ রোগ, অর্থাৎ - যত দ্রুত এটি ধরা পড়বে, তত ভালো ভাবে একে নিয়ন্ত্রণ করা এবং তার প্রগতি রোধ করা সম্ভব।
1980 থেকে 2008 সালের মধ্যে সারা বিশ্বে সংগঠিত প্রায় 35টি সমীক্ষার উপরে ভিত্তি করে করা বিশ্লেষণে একটি তথ্য উঠে এসেছে। ডায়াবেটিস রোগীদের চোখের রেটিনাল ইমেজে দেখা গিয়েছে, এই রোগে আক্রান্তদের দৃষ্টিশক্তি অন্তত 35% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- রোগীদের মধ্যে অন্তত 12%-এর মধ্যে এই রোগের উপস্থিতি রয়েছে4।
তাই প্রতি বছর চোখের পরীক্ষা করান (ডাক্তারের কাছে যান, চশমার দোকানে নয়!), এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
মিথ 6: আমার চোখে কোনও গুরুতর সমস্যা হলে সাথে সাথে বুঝতে পারব।
চোখের অধিকাংশ সমস্যার ক্ষেত্রেই, রোগীরা প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও উপসর্গ বুঝতে পারেন না- অথচ এই পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করা সবচেয়ে জরুরি। যেমন ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, জটিল আকার ধারণ না করা পর্যন্ত রোগী কোনও উপসর্গ বুঝতে পারেন না7।
একদম ঠিক পড়েছেন: কোনও যন্ত্রণা নেই। দেখতেও সমস্যা হবে না। কিছু বুঝতেও পারবেন না7। রেটিনা সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার যুগ্ম সচিব ডঃ মণীষা আগরওয়াল মনে করেন, একদম প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের উপসর্গ হল পড়তে অসুবিধা হওয়া। চশমা বদলালেও এই সমস্যার হাত থেকে মুক্তি মেলে না। এই উপসর্গ খুব সাধারণ মনে হলেও একে উপেক্ষা করা উচিত নয়। অবহেলা করা হলে, এই রোগ ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করবে এবং শীঘ্রই চোখের সামনে কালো মেঘের মতো কিছু ভাসতে বা লাল ছোপ দেখা দেবে, বা কিছু ক্ষেত্রে চোখে রক্তক্ষরণের কারণে আচমকা ব্ল্যাকআউট হয়ে যেতে পারে।
সৌভাগ্যবশত, উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই এই রোগ নির্ণয় করার জন্য চোখের পরীক্ষা করানো যায়। একদম যন্ত্রণাবিহীন ডাইলেটেড চোখের পরীক্ষা, যেখানে ডাক্তার আপনার চোখেবিশেষ ধরনের আই ড্রপ দিয়ে চোখের তারারন্ধ্রকে প্রসারিত করে তুলবেন, যাতে চোখের পিছনের অংশ পরীক্ষা করা যায়7 (যেখানে রেটিনা আছে)।
এত সহজ একটা পরীক্ষা আপনার দৃষ্টিশক্তি বাঁচাতে পারে। একটু সচেতন হলেই এই ধরনের প্রতিরোধযোগ্য রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
যে কোনও রোগকে পরাজিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল সেটি সম্পর্কে জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি করা। নিজের স্বাস্থ্য এবং দৃষ্টিশক্তি সুস্থ রাখার চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখুন। বিশেষ করে যদি আপনার বা আপনার পরিজনদের মধ্যে কারও শরীরে ডায়াবেটিস রোগ ধরা পড়ে, তাহলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এবং Netra Suraksha initiative সম্পর্কে বিশদে জানতে News18.com ফলো করুন। তাছাড়াও, অনলাইনে Diabetic Retinopathy Self Check Up করিয়ে নিন এবং দেখে নিন আপনাকে এখনই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে কি না।
আপনার ব্যক্তিগত ঝুঁকি কমানোর জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের দেওয়া ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান মেনে চলুন। সবচেয়ে সহজ পরামর্শ হল, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এড়াতে বছরে একবার আপনার চোখের পরীক্ষা করান- এটি একটি সরল, সহজ, যন্ত্রণাবিহীন পরীক্ষা। এই একটি পরীক্ষা আপনার এবং আপনার পরিবারের জীবনের মান বজায় রাখতে সাহায্য করবে। তাই আর বিলম্ব করবেন না। আপনার কোনও রোগ হতে পারে না, এই ভুল ধারণা ভেঙে বেরিয়ে আসুন।
References:
1. https://www.medicalnewstoday.com/articles/diabetes-in-india[U1] 10 Dec, 2021.
2. https://www.nei.nih.gov/about/news-and-events/news/glaucoma-silent-thief-begins-tell-its-secrets 17 Dec, 2021
3. https://www.nei.nih.gov/learn-about-eye-health/eye-conditions-and-diseases/cataracts 17 Dec, 2021
4. https://www.nei.nih.gov/learn-about-eye-health/eye-conditions-and-diseases/diabetic-retinopathy 10 Dec, 2021
5. Balasubramaniyan N, Ganesh KS, Ramesh BK, Subitha L. Awareness and practices on eye effects among people with diabetes in rural Tamil Nadu, India. Afri Health Sci. 2016;16(1): 210-217.
6. https://care.diabetesjournals.org/content/27/suppl_1/s84 17, Dec 2021
7. https://youtu.be/nmMBudzi4zc 29 Dec, 2021