বস্তুত রবিবার দুপুরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফল (West Bengal Election Results 2021) স্পষ্ট হতেই সমাজবাদী পার্টি থেকে শিবসেনা, আপ থেকে ন্যাশনাল কনফারেন্স, সমস্ত বিরোধী দলের নেতারাই মমতার লড়াকু, একরোখা ভূমিকার অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে একের পর এক টুইট ও বিবৃতি। যেন তাঁরাও ধরে নিয়েছেন, মোদিকে হারাতে মমতাই হতে পারেন একমাত্র মুখ।
advertisement
প্রসঙ্গত, বাংলা ছাড়া অসম, তামিলনাড়ু, কেরালা ও পুদুচেরিতে 'প্রত্যাশিত' ফলই করেছে গেরুয়া শিবির। অসমে ফের ক্ষমতায় আসা, তামিলনাড়ু-কেরলে পরাজয়, কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরিতে আবার জয়-বিজেপির প্ল্যান ফেল করেনি এই চার রাজ্যে। কিন্তু বাংলা নিয়ে বিরাট পরিকল্পনা ছিল BJP-র। কিন্তু মমতা-ঝড়ে সেই প্ল্যানে মাঠে মারা পড়ল। বিজেপির 'ইস বার, দোশো পার' দাবি ধুলিসাৎ হয়ে গেল। তাই নন্দীগ্রামে মমতা হারলেও তিনি আসলে গোটা বিজেপিকে হারালেন। বাস্তবে মমতা জিতে গেলেন। সেই 'ফর্মুলা'টাই এখন গোটা দেশের প্রেক্ষাপটে ফেলতে চাইছে বিরোধীরা।
রাজনৈতিক মহলের মতে, জয় অনেকটা আফিমের নেশার মতো, যা কিছু মানুষকে মারাত্মক এনার্জি দিয়ে থাকে। মমতার কাছেও নির্বাচন জয় অনেকটা তেমনই। নন্দীগ্রামের বিরুলিয়া বাজারে ভোটের কত আগে পায়ে চোট পান মমতা। চিকিৎসকরা তাঁকে এক মাসের বিশ্রামে থাকতে বললেও তা মানেননি তৃণমূল নেত্রী। দিন দুই পর থেকেই পায়ে প্লাস্টার আর হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়েছিলেন ভোট প্রচারে। তারপর থেকে সেই হুইল চেয়ার নিয়েই শেষ করলেন বাংলার ভোট। 'নিজের' পায়ে উঠে দাঁড়ালেন রবিবার, বাংলা জয়ের পর।
এবারের নির্বাচন বাংলার হলেও তা আদতে হয়ে উঠেছিল মোদি বনাম মমতার লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে আনতেই মমতাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে বিরোধী শিবির। যদিও বিজেপির কাছে আপাতত নন্দীগ্রামে মমতার পরাজয়টাই যা একটু 'স্বস্তির' জায়গা। আর অসমে ক্ষমতা ধরে রাখা তাঁদের মুখরক্ষা। রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারনা ছিল, অসমে সর্বানন্দ সোনওয়াল ও হিমন্ত বিশ্বশর্মার অন্তর্দ্বন্দ্ব কংগ্রেসকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। যদিও বাস্তবে কংগ্রেস ও বরউদ্দিন আজমলকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে বিজেপি। অপরদিকে, পুদুচেরিতেও প্রথম খাতা খোলা আর সরকার গঠন করাই চরম 'দুঃসময়ে' গেরুয়া শিবিরকে একটু অক্সিজেন দিতে পারে।
কেরলে এতদিনের ঐতিহ্য় ছিল, একবার বাম এবং অন্যবার কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটে ক্ষমতায় আসা। এ বার সেই রীতির বদল হয়ে গেল। কারণ, বাম জোট এলডিএফ ফের ক্ষমতা ধরে রাখল। কংগ্রেসের জোট ইউডিএফ দ্বিতীয় আর বিজেপি তৃতীয়। গেরুয়া শিবিরের কাছে এই ফল অপ্রত্যাশিত নয় একেবারেই। যেমন অপ্রত্যাশিত নয় তামিলনাড়ুর ফলও। দক্ষিণের রাজ্যে যে দশবছর পর ডিএমকে-ই ক্ষমতায় আসছে, বিজেপি-র জোটসঙ্গী এআইএডিএমকে নয়, তা ভোটের আগেই কার্যত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভোটের ফলেও তাই প্রমাণিত হল।
কিন্তু আসল লড়াই ছিল বাংলায়। বিজেপির স্বপ্ন ছিল বিরাট। অপরদিকে, মমতা ডাক দিয়েছিলেন, 'খেলা হবে'। মোদি-শাহরা যতই দুশো আসন জেতার দাবি করুন না কেন, লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্য থাকলেও দুশো আসন নিয়ে সন্দিহান ছিলেন বিজেপির অনেক রাজ্য নেতাই। তবে, ক্ষমতায় আসার বিষয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন তাঁরাও। বাংলার মুসলিম ভোট তৃণমূলে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বিজেপি হিন্দুত্বের রাজনীতিও আমদানি করেছিল বাংলায়। দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজোয় মমতার সরকারের বাধা দেওয়ার মতো অভিযোগও বারবার তুলে ধরেছিল গেরুয়া শিবির। ছিল মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিপুল প্রচারও। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হল না। মমতার কাছে ধরাশায়ী হলেন মোদি-শাহরা।
মমতা অবশ্য পালটা হাজির হয়েছিলেন বহিরাগত তত্ত্ব নিয়ে। বারবার নির্বাচনী সভায় বলেছেন, 'বাংলাকে গুজরাত হতে দেব না। বহিরাগতদের বাংলা লুঠ করতে দেব না।' একইসঙ্গে প্রশান্ত কিশোর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ স্লোগান তুলে বাঙালি অস্মিতাকেও জাগিয়ে তুলেছিল তৃণমূল। লোকসভা ভোটের পর তৃণমূলের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট হয়ে আসার পর থেকে তৃণমূলস্তরে সমীক্ষা, স্থানীয় ইস্যু নিয়ে কাজ এবং সেইমতো রণকৌশল তৈরি করে তৃণমূলকে ছকে বসিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। ‘দিদিকে বলো’, ‘দুয়ারে সরকার’, ‘পাড়ায় সমাধানে’র মতো কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের কাছে ফের গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পেয়েছিল তৃণমূল।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রবিবার বাংলা জয়ের পরপরই দেশবাসীকে বিনামূল্যে কোভিড প্রতিষেধক দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'বিনামূল্য ভ্যাসসিন না দিলে অহিংস আন্দোলন করব।' সেইসঙ্গে, শরদ পওয়ার, সীতারাম ইয়েচুরি, উদ্ধব ঠাকরে, সনিয়া গাঁধী-সহ মোট তেরো জন বিরোধী নেতার সঙ্গে মমতার একটি যৌথ বিবৃতিও প্রকাশ হয়। বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের দাবি প্রথম তুলেছিলেন মমতাও। জানা যাচ্ছে, করোনা নিয়ে কেন্দ্রকে চেপে ধরতে সনিয়া গান্ধী নন, মমতাকেই সামনে রাখতে চাইছে বিরোধীরা।
বাস্তেব মমতার কট্টর মোদি বিরোধিতার শুরু সেই ২০১৪ সালেই। লোকসভা ভোটে জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ধারাবাহিক ভাবে মোদি-বিরোধিতা করে গিয়েছেন মমতা। ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে বারবার সরব হয়েছেন। নোটবাতিল থেকে জিএসটি নীতি, সিএএ, এনআরসি'র মতো নানা ইস্যুতে সবচেয়ে জোরাল বিরোধী স্বর ছিলেন মমতাই।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা করা গিয়েছেন। ঘোষণা করেছিলেন, ভোটে জিতে বিরোধী জোটই সরকার গড়বে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ফের ক্ষমতায় আসেন মোদি। কিন্তু ২০২১-এর বাংলার নির্বাচন অনেক সমীকরণ বদলে দিল। মমতা দেখালেন 'সর্বশক্তির' মোদিকে হারাতে তিনি পারেন। সেই মমতার সেই সাফল্যকেই ২০২৪ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বিরোধীরা। পরিস্থিতি যা, তাতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন হতে চলেছে মোদি বনাম মমতা।
------ব্রজেশ কুমার সিং