১৯৯৯ সালে যখন প্রথম কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াক শুরু হয়, তখনও খুব স্বাভাবিক ভাবেই দ্বিধায় ছিলেন শহরের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অনেকেই। কামালের মতো অনেকেই মুখ দেখাতে চাইতেন না। এখন যদিও ছবিটা আলাদা। তাঁর কথা সবাই জানে, তিনি থাকেন সবার চোখের সামনে সমাধিরূপে। আর এই শহর? শুরুর দিকে তো বটেই, কয়েক বছর আগে পর্যন্তও আমাদের প্রচুর মাস্ক বানাতে হত। এখন আর হয় না। বিশেষ করে এই বছর প্রায় কেউই মাস্ক হাতে তুলে নেননি, সবাই মাথা উঁচু করে হেঁটেছেন শহরের রাজপথে, বলছিলেন কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াক এবং কলকাতা প্রাইড মান্থের সঙ্গে যুক্ত অন্যতম উদ্যোগী সৌভিক ঘোষ।
advertisement
ইতিহাস চলতি বছরের কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াকের শরীরে মিশেছে আরও এক পরতে। পথের বাঁক মোড় ফিরে এসেছে অনুষ্ঠানে, শীতের শহর যখন আলতো আবেশে আড়মোড়া ভাঙছে, ঠিক তখনই। ১৯৯৯ সালে যাঁরা প্রথম শহরের বুকে সদর্পে পদচারণা করেছিলেন ভালবাসার অকুণ্ঠ দাবিতে, সেই সময়ে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন পার্ক সার্কাস থেকে পার্ক স্ট্রিটের গন্তব্য। এত বছর পরে, আবার সেই গর্বের পথ সেজে উঠেছে রামধনু ধ্বজায়, পতাকার সোল্লাসকে সঙ্গত দিয়েছে উত্তুরে হাওয়া। আর এই পথের অনেক মঞ্জিল, অনেক ইমারত, অনেক কাফে, অনেক পানশালা মাথা ঝুঁকিয়েছে, সেলাম ঠুকেছে, বাড়িয়ে দিয়েছে উষ্ণ হাত স্বতস্ফূর্ততায়। শহরে ইতিউতি উড়েছে সাতরঙা দাবির লহর, কোণঠাসা করার প্রশ্নই ওঠে না, বরং এলজিবিটি সম্প্রদায়ের পতাকা শোভা পেয়েছে বাড়িগুলোয়, আর কিছু দিন পরেই শহরের পথের যে অনেক অংশ মোড়া থাকবে বড়দিনের সাজে, সেই সব জায়গায় চোখে পড়েছে রামধনু পতাকার সাজ।
শহর যদি এত নিবিড় ভাবে আপন করে নেয় তার তথাকথিত অন্যরকম ছেলেমেয়েদের, তাহলে উচ্ছ্বাসের জোয়ার তো সব বাঁধ ভাঙবেই! সৌভিক সেটাই বলছিলেন। কথায় কথায় তিনি জানিয়েছেন যে কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াক ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে এক খাত থেকে অন্য খাতে, মূল সুর যদিও এক তারে বাঁধা। যেরকম, এবারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিশেষ এক মুহূর্ত উদযাপিত হয়েছে সেই সব যৌনকর্মীদের জন্য, সংজ্ঞা যাঁদের সমকামী তকমায় বেঁধেছে। ‘‘কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াক বাঁধাধরা কোনও গণ্ডির মধ্যে থাকতে চায় না, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে আমাদের পথচলা’’, দাবি সৌভিকের। সত্যি বলতে কী, এই সবার সঙ্গে মিলে যাওয়ার ঐকতান শুরু হয়েও গিয়েছে এলজিবিটি সীমা ছাড়িয়ে। সৌভিক বলতে ভোলেননি, কলকাতা পুলিশ যে ভাবে তাঁদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্য আর সমর্থনের হাত, তা ভোলার নয়, তাঁদের আশ্বাস নিরাপদে থাকার সাহস দিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত সবাইকে।
ভালবাসা অতএব সব পথে বয়ে যাক, এটুকুই চাওয়া নিয়ে এই বছরের মতো শেষ হয়েছে কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াক। ‘‘শুধু আমরা নই, সব মা-বাবা, সব সহকর্মী, সব বন্ধুর সাহচর্য আর সান্নিধ্য এসে মিশুক এই ধারায়, তার শুরুটা হয়েছে যদিও, এর চেয়ে বেশি আর কী বা চাইতে পারি’’, ক্লান্তিতে গলা ধরে এলেও আনন্দের রেশ সেখানে স্পষ্ট সৌভিকের। কলকাতা রেনবো প্রাইড ওয়াকের সাংস্কৃতিক মঞ্চ এই বছর সাক্ষী থেকেছে তাঁর আগুনঝরানো ডান্স পারফরম্যান্সের, পতাকা হয়ে বাতাস চিরেছে তাঁর এবং বাকিদের উদ্বেলিত হৃদয়। তার আর পর নেই, আসছে বছর আবার হবে, এই যা বলার!