পাবনার পিতৃপুরুষের ভিটা ছেড়ে দেবেশ রায়ের ঠাকুরদা উমেশচন্দ্র রায় চলে আসেন ১৯৪৩ সালে।এই ‘ভিটা’ নিয়েই, শেকড়ের সন্ধানেই তাঁর সৃজনমননের যাবতীয় নির্মান, স্বপ্ন, কল্পনা। এই শেকড়ের অন্বেষণে ছুটে চলা। সেই ছুট আজ থামল। আত্মকথায় যিনি লিখেছিলেন, “ঠাকুরদার নাম জানি না—মানুষটি জড়িয়ে আছেন। ঠাকুরদার বাবার নামটাও ঠিক কী জানি না । তবে জানাটা একেবারে অবিশ্বাস করি না।… ঠাকুরদা থেকে আমি পর্যন্ত যদি তিন প্রজন্ম ধরা যায় তাহলে বলা যেতে পারে এই তিন পুরুষের বেশির ভাগ সময়েই আমাদের বাড়ি ছিল না। অথচ আমরা, আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই বাড়িমনা। আমাদের সেই বাড়ি, সব সময়ই স্মৃতির বাড়ি । যেন আমরা যে যেখানে আছি সেতা আমাদের বাড়ি নয় । অন্য কোথাও আমাদের একটা বাড়ি আছে । আমরা সেদিক দিয়ে স্মৃতিতাড়িত বংশ । সব সময়ই নিজেদের বাড়ি খুঁজে বেড়াই । ইহুদিদের মতো । কিংবা আফ্রো আমেরিকানদের মতো ।আমাদের বাড়িতে কোনোদিন না-জানা দেশ থেকে মানুষজন আসতেন, তাঁরা দু-একদিনের মধ্যেই আমাদের সেই আসল দেশটার আভাস দিয়েই চলে যেতেন, কিন্তু তাতে তো এটাই প্রমাণ হত নির্ভুল – আমাদের সত্যিকারের এক দেশ আছে । ” (আত্মকথা, গায়ে গায়ে বাঁচা । আরম্ভ জুন ২০১৩)
advertisement
কৈশোরের শহর জলপাইগুড়িতে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বেরানো এই মানুষটার ভেতরে তাঁর নিজস্ব যে ভুবন তা তাঁর বেড়ে ওঠার জগত, নিজের কথায় যেমন লিখেছেন, ‘দেশ বিদেশের কোথাও আমার বাড়ির হদিস করলে আমি জলপাইগুড়িই বলে । ম্যাপে জলপাইগুড়ি বের করা মুস্কিল। আমি তখন, পূর্ব হিমালয়ের নেপাল-সিকিম-ভুটানের অপর আঙ্গুল চালাই।’
দেবেশরায়ের দাদু ১৯১৭ সালে জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার হিসেবে অবসর নেন । এই হিসাবে এই শহরের সঙ্গে তাঁদের তিন পুরুষের টান । দাদুর অবসরের তাঁদের পাকাপাকিভাবে জলপাইগুড়ি চলে আসা। ২০০০এর সূচনায় পাকাপাকিভাবে শেকড় ছিঁড়ে চলে যান তাঁরা ।কিন্তু শেকড় ছেঁড়ার অদ্ভূত যন্ত্রণা তাঁকে তাড়িয়ে বে়ড়ায়, উত্তরের কথায় সে যন্ত্রণা চোখমুখে টের পাওয়া যায়। প্রতি বছরই তাই এসে ঘুরে যান, গত বর্ষাতেও তেমনই তিস্তা নদী এবং তারঁ মানুষজনের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বুকভরে শ্বাস নিয়েছেন তাঁর তার শেকড়ের কাছে।
১৩-১৪ বছর আ্গে দেবেশ রায় লিখেছিলেন-"কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়িতে আমাদের বিকেলটা- সন্ধ্যেটা একটু নিঝুম ... কাকলি বাড়িতে থাকলে গানের গুঞ্জন শোনা যায় একটু, না থাকলে তা নয়। সেই সময় বাইরের আকাশে সন্ধ্যে হওয়া, রাতপোকাদের প্রথম আওয়াজ ও সকাল জুড়ে পাখিদের দলবাঁধা পারাপার শোনা যায় । ঘরের চেয়ারে বসে বসেই অনেকটা বেড়ানো যায়। শুনেছি মাত্র বিশ ধাপ ওপরে বিশাল ছাদ সারা আকাশময় ও ভ্রমণ সম্পন্ন। ওই বিশটি ধাপ পেরোতে পারি না ।"
জীবনসঙ্গী কাকলি রায়, অসাধারণ গাইতেন, তিনি জুড়ে রেখেছিলেন দেবেশ বাবুর সংসার। সেই কাকলিদি চলে যাওয়ার পর সম্পূর্ণ একা হয়ে যান দেবেশবাবু। তাই হয়ত ফাঁকা ফ্ল্যাটবাড়িতে তাঁর দম বন্ধ হয়ে উঠতো । গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বাসায় যখন এই নিঃসঙ্গ মানুষটির সাথে দেখা করতে যাই, তিনি বললেন, আমাকে জলপাইগুড়ি থাকতে দেবেন? আপনাদের কাছে, আমার নিজের জায়গায়? কিন্তু চিকিৎসার কারণে ছেলের অনুমতি মিলবে না তাও জানালেন।তবুও কথা হল পুজোর লেখালেখির চাপ সামলে নিয়ে তারপর জলপাইগুড়ি আসবেন । কিন্তু সেই শেকড়ের কাছে আসা আর হলো না তাঁর ।
মনে পড়ে যায় গত বর্ষায় জলপাইগুড়িতে এক সান্ধ্য আড্ডায় বলা তাঁর কথাগুলো, “আমার উপন্যাস লিখবার একমাত্র কাজ যদি হয় ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা তা হলে আমাকে আর একটা শক্তিতেও বিশ্বাস করতে হয়, যে শক্তি ইতিহাসটা তৈরি করতে পারে।ব্যক্তি, দেশ ও কালের সীমা অতিক্রম করেও সেই শক্তি সক্রিয় থাকতে পারে। সেই শক্তিটা কমিউনিস্ট পার্টি।” আমরা এই বিশ্বাসের অনুরণন শুনি তাঁর প্রতিটি বৃত্তান্তে, যেখানে আখ্যান হয়ে ওঠে সময়ের দলিল। আমাদের নিঃস্ব করে চলে গেলেন এই আখ্যানকার ।
জন্মেছিলেন ১৯৩৬এর ১৭ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার বাঘমারা গ্রামে । দেশ ভাগের আগে, ১৯৪৩ সালেয সাত বছরের দেবেশ গ্রামের সেই বাড়ি থেকে জলপাইগুড়ি চলে আসেন দাদুর চাকরির ঠিকানায় । ১৯৫২ সালে ছাত্র দেবেশ জিলা স্কুল থেকে ফাইনাল পাশ করে আনন্দচন্দ্র কলেজে ভর্তি হন । ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে বাংলা অনার্স নিয়ে পাশ করেন । ১৯৫৮তে এম এ পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে , এর পর সেই শেকড়ের টানেই আনন্দচন্দ্র কলেজে শিক্ষকতা নিয়ে আসেন । ১৯৫৮-৭৫ এক টানা এই কলেজে অধ্যাপনা করেন, এর পর আবার কলকাতা, সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সে যোগ দেন।
রাজনৈতিক কর্মীর জীবন তাঁকে পরবর্তীতে রসদ দিয়েছে। সে কথা নিজেই বলেছেন, “বাষট্টির চিন ভারত সীমান্তের ঘটনার ফলে পার্টি যখন ভাঙছে তখন ঘটনাচক্রে জলপাইগুড়িতে আমি প্রায় একক এবং সম্পূর্ণই একা । প্রায় বছর দুয়েকে প্রবল রাজনৈতিক, তাত্বিক ও সাংগঠনিক একতা লড়াই গেছে, এটা আমার একটা অদ্ভূত অভিজ্ঞতা। ... তত্ব ও তার কার্জকর চেহারা কি হতে পারে সেটা আমার অভিজ্ঞতার ভেতরে যে স্থায়ীভাবে সেদিয়ে গেছে- তার আন্দাজ পাই। ... কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে থাকার ফলে, খাদ্য সংকটের ফলে, লোকজনের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার ফলে, এখন হয়তো আমি লেখার কোনও কোনও সময় খুব করুণ এবং খারাপ অবস্থাতেই রসিকতা করে ফেলতে পারি । এটা আমার পক্ষে সম্ভবই হতো না যদি আমি ওই চালের লাইনের অভিজ্ঞতা ও কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর দিয়ে না আসতাম ।”
উত্তর জনপদের মানুষজনকে , তাঁদের বাঁচার যুদ্ধ, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গ তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির ফসল ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তা পুরাণ’-এর মত ব্যাপ্ত ও বস্তৃত আখ্যান, অথবা ‘আপাতত শান্তি কল্যান হয়ে আছে’, মানুষ খুন করে কেন’-র মতো লেখা।
দেবেশ রায়ের দাদা দীনেশ রায় সম্পর্কে তিনি বলতেন, বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য যে তিনি স্বল্পকালীন জীবনে মাত্র তিন চারটের বেশী উপন্যাস লিখে যেতে পারলেন না ‘সোনাপদ্মা’ উপন্যাস বা ‘একটি ঐরাবতের মৃত্যু’ দীনেশ রায়ের ক্ষমতার সাক্ষ বহন করছে। এই বড়দাদার হাত ধরেই তার লেখালিখির জগতে পদার্পন বলা যায় । ১৯৫৩-তে জলপাইগুড়ির পত্রিকা ‘জলার্ক’এ প্রকাশিত ‘নিশিগন্ধা’ তাঁর মুদ্রিত প্রথম লেখা। এর পর তিস্তাকে নিয়ে লিখেন ‘মৃতদংশন ও বিপজ্জনক ঘাট’। এভাবেই তাঁর রাজনীতির মানুষ থেকে সাহিত্যের অঙ্গনে চলে আসা।
জলপাইগুড়ি গর্বের সন্তানকে হারাল। যে গোটা জীবন বহন করেছেন একটি নদীকে, এই নদীর জল হাওয়া মাটির মানুষের স্মৃতি । আজ শেষ বেলায় তাঁর লেখাই ফিরে পড়ি, ‘তিস্তা পৃথিবীর যে কোনো নদীর সমস্পর্ধী । এ এক অদ্ভূত বৈপরীত্য। তিস্তা যখন আমাদের ঘরের সিঁড়িতে বা দরজাতেই তখন সে দৈনন্দিনের অংশ হয়ে যায়। সে আর অচেনা থাকে না, আর, যখন সে অচেনা তখন আর সে দৈনন্দিন থাকে না, জলপাইগুড়ি শহর নিয়ে ও তিস্তা নিয়ে দৈনন্দিন আর অচেনার এই দ্বন্দ্ব আমার মিটল না। ... তখন স্মৃতি এসে বাস্তবের দখল নিয়েছে। তখন তো আমার শৈশবের সেই পুকুরগামী জলপ্রপাত দিগন্তগামী হয়েও তিস্তার জলপ্রলয় হয়ে উঠছে। তখন তো আমি আমার শৈশবের জলস্রোতকে ফিরে পেয়েছি। স্মৃতি বড় কঠিন অসুখ । সে আগুনে লোহা গলে যায়।"
তিস্তা এর পরেও বইবে। এই বর্ষায় আবার ভাসবে চর। আমরা বিকেলে নদীর চরে যাব পড়ন্ত বিকেলে। দেবেশ রায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবেন কোনও পথের বাঁকে। ফেরার পথে দেখা হয়ে যাবে।
-গৌতম গুহরায়।
