মোটের উপর গল্পটা সকলেই জানেন৷ কল্লোল লাহিড়ির ইন্দুবালা ভাতের হোটেল সাম্প্রতিক সময়ের জনপ্রিয়তম উপন্যাসগুলির একটি৷ এই পোড়া, আধা-খ্যাচড়া বাংলাদেশের খণ্ডিত জাতিসত্ত্বার মাঝে পড়ে যাওয়া এক বাঙাল মেয়ের গল্প৷ যে ‘স্মৃতির সঙ্গে যুদ্ধ’ করে চলে অবিরাম৷ চোখের সামনে একের পর মৃত্যু দেখে, আর জীবন ইতিহাসের পাতার মতো সেই শোকগাথাকে লিপিবদ্ধ করে চলে৷ ইন্দুবালা মল্লিক বাঙালির সবচেয়ে কঠিন ও অনিশ্চিত সময়ের এক ব্যক্তিগত ইতিহাস৷ পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য তাই একসঙ্গে তিন সময়কে মিলিয়ে দিয়েছেন এই ইতিহাস ও সম্পর্কের গল্পে৷ সঙ্গে এসেছে পঞ্চব্যাঞ্জন থেকে পান্তা, আমতেল থেকে চন্দ্রপুলি-সব কিছুই৷
advertisement
শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, স্নেহা চট্টোপাধ্যায়, সুহত্র মুখোপাধ্যায়, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতীক দত্ত, অঙ্গনা রায় অভিনীত ইন্দুবালা ভাতের হোটেল আসলে বাঙালির এক সময়ের সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল৷ সে একান্ত নিজস্ব৷ সে ইতিহাস জাতি-অন্তর্গত কেউ ছাড়া অনুভব করা সম্ভব নয়৷ হয়ত জানা সম্ভব, কিন্তু অনুভব করা সম্ভব নয়৷ যে মাটির উনুন দেখেনি, চৈত্রের ঝড়ের কাঁচা আম কুড়ানো দেখেনি, কপোতাক্ষের বান দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধে রক্তের স্নান দেখেনি, নকশালবাড়ির আগুন দেখেনি, সে বাঙালির ইতিহাসকে অনুভব করবে কী করে৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালি পারবে তা অনুভব করতে, কারণ তাঁর অজ্ঞাত মানসিকতার ইতিহাসে এই রক্তের আখর সঞ্চিত হয়ে থাকবে জিনের বয়ে আনা সম্পত্তির অংশ হিসাবে৷ তাই বাঙালিরই একে অনুভব করা সম্ভব, আর কারওর নয়৷ দেবলায়ের ওয়েব সিরিজ সে কথা প্রমাণ করেছে প্রতি অক্ষরে৷ শুভশ্রী যেমন করে মুগ্ধ করেছেন অভিনয়ে, তেমনই সুহত্র, অঙ্গনা, মিঠু চক্রবর্তীরাও অবাক করে দিয়েছেন তাঁদের সাবললীতায়৷
আরও পড়ুন - স্বামীকে ছেড়ে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে কী পরিণতি তরুণীর, শুনলে শিউরে উঠতে হয়
আরও পড়ুন - বড় খবর! তিহাড় জেলে তীব্র অসুস্থ অনুব্রত মণ্ডল, দিতে হচ্ছে ইনসুলিন ও অক্সিজেন
বাঙাল ‘মাইয়্যা’ ইন্দুবালা মল্লিক এ-পার বাংলায় এসে শান্তিপুরী বাংলা শিখে নেয় বটে, কিন্তু তাঁর ‘ঠাকমার’ হাতের রান্না ভোলে না৷ মত্ত স্বামীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর টিকে থাকতে সে শুরু করে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল৷ রন্ধন পটিয়সী ইন্দুবালার রান্নায় মুগ্ধ খদ্দেরের সংখ্যা বাড়তে থাকে রোজ৷ ক্রমে কলকাতায় ও পার বাংলার ‘কলাপোতা’-র মেয়ে ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে৷ কিন্তু সময়ের আবর্তনও হতে থাকে সঙ্গে সঙ্গে৷ সিরিজে আমরা তিনটি সময়ের গল্প একসঙ্গে দেখি, কখনও তার থেকে বেশিও দেখতে পাই৷ একটি ইন্দুর ছোটবেলা, ওপার বাংলায়৷ একটি এ পার বাংলায় ইন্দুর বিবাহ পরবর্তী জীবন, তৃতীয়টি বৃদ্ধা ইন্দুবালার বর্তমান জীবন৷ খুব সাধারণ এক মেয়ের গল্পে বারংবার ফিরে-ফিরে আসতে থাকে আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ৷
ইন্দুবালা আসলে কে? ইন্দুবালা আসলে সেই লাখো-লাখো কাঁটাতার পার হওয়া রিফিউজিদের একজন৷ বাড়ির পাশের চাষ জমি পেরিয়ে নদীর উপর নাও ভাসিয়ে যে লাখে-লাখে মানুষ শেষ পর্যন্ত মরো-মরো হয়ে ঢুকে পড়েছিল ‘কলক্যাত্তা’-শহরে, ইন্দুবালা তাঁদের একজন৷ ইন্দুবালা ওপার বাংলা ও এ-পার বাংলার মধ্যে বৈবহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া এক নতুন পারিবারিক সমীকরণের এক প্রতিনিধিও বটে৷ পাশাপাশি ইন্দুবালা প্রেমিকা৷ শৈশবে জাত-ধর্ম ভুলে প্রেমে পড়ার প্রতিনিধি ইন্দুবালা৷ ইন্দুবালা বরানগর, কাশিপুর কিম্বা দমদমের সেই রিফিউজি মায়ের পরিবারের একজন, যিনি পোড়া দেশকে বাঁচাবে বলে ঝাঁপিয়ে পড়া একদল তরুণের কাছে, ‘কমরেড’৷ মুক্তির দশকে মধ্যরাতে পুলিশের তাড়া খেয়ে খিদে পেটে থাকা ফুটন্ত তরুণকে এক চিলতে আশ্রয় ও পেটে দুটো অন্ন দেওয়া ‘মায়ের প্রত্নপ্রতিমা’ ইন্দুবালা৷ শেষ পর্যন্ত ইন্দুবালা প্রাণপণে নিজের সর্বস্ব দিয়ে মন প্রাণ আঁকড়ে থাকা এক ইতিহাস গ্রন্থ, যার পাতায় পাতায় অনৈতিহাসিক ঘটনা বাঁধা সম্পর্কের বুননে৷
বাঙালির মহাকাব্য রামায়ান, মহাভারত নয়, নকশী কাঁথার মাঠ৷ বাঙালির সঙ্গীত লালন, সিরাজ সাঁই হয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল৷ ছবিতে সঙ্গীতের কাজ করেছেন অমিত চট্টোপাধ্যায়৷ গান গেয়েছেন ইমন চক্রবর্তী, জয়তী চক্রবর্তী, ইক্ষিতা মুখোপাধ্যায়, অনির্বান ভট্টাচার্য. চক্রপাণি দেব, তিতাস ভ্রমর সেন-সহ অনেকেই৷ সঙ্গীত এই সিরিজের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বারংবার৷ এক সূত্রে আটকে পড়েছেন এই ভাঙা বাংলাদেশের কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিকর্তারা৷ শুভশ্রী, স্নেহা থেকে সুহত্র, সকলের অভিনয় কত ভাঙা বাঙালির হৃদয় বিদীর্ণ করেছে বারংবার, সে কথা বোধহয় এতক্ষণে টের পাচ্ছেন পরিচালক নির্মাতারা৷ তবে শেষে এ কথাও বলে রাখা ভাল, ছবির শিল্প নির্দেশনায় আরও একটু যত্নবান হলে পারতেন পরিচালক, তাতে রন্ধন আরও সুস্বাদু হত বৈকি৷
দ্বারের এক প্রান্তে আটপৌড়ে করে সাদা শাড়ি জড়ানো বিধবা ইন্দুবালা শুরুতেই একটা কথা বলেছিলেন, অতিথি এলে সে যেন না খেয়ে বাড়ি থেকে না যান৷ হয়ত অনেক জাতিই অতিথি পরায়ণ, কিন্তু সময়, জাত, পরিস্থিতি না বিচার করে পেটের অন্নসংস্থানের আয়োজন এমন সস্নেহে আর কে করে বাঙালি ছাড়া! যে ছেলে দেশের কাজ করবে বলে তিন-রাত খায়নি, আর কোন জাতি তাঁকে রাত বিরেতে পাত পেড়ে খাওয়ায়, বিনা প্রশ্নে৷ পুলিশের চোখ এড়িয়ে তাঁর আনাগোনা কমলে কোথায় এমন দুঃশ্চিন্তা হয় ক্ষণিক পরিচিতা মাতৃসমা মহিলার! টাকা না থাক, অতুল ঐশ্বর্যের গরিমা না থাক, খণ্ডিত বাঙালির এই গর্ব তো আছে, যতদিন ইন্দুবালারা আছেন৷
‘কমরেড ইন্দুবালা, আপনারা থাকুন৷ আপনারা থাকলেই আমরা থাকব৷’