রাজস্থানের খাজুরিয়া নামের একটি ছোট্ট গ্রামে জন্ম তাঁর। বয়স তখন মাত্র সাত। ঘুড়ি নিতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে গেলেন তিনি। হাতে একাধিক ফ্র্যাকচার। বাবা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে। যন্ত্রণায় কাতর তিনি। দু'বছর বাড়িতে ছিলেন। তখনই মন ভোলানোর জন্য টিভি, সিনেমা দেখেছেন প্রচুর। নকল করেছেন বহু অভিনেতাকে। তিনি অভিনেতা হতে চান, এভাবেই বুঝতে পেরেছেন ইরফান।
advertisement
জয়পুর থেকে এমএ পাশ করে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা। সেখানেই পরিচয় ওয়ার্ল্ড সিনেমার সঙ্গে। অভিনয়ের খুঁটিনাটি শিখে ইরফান পাড়ি দেন মায়া নগরি মুম্বইয়ে।
স্ট্রাগল করার সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন তিনি। নাক টিকলো করার জন্য শোয়ার সময় নাকি নাকে পিন লাগিয়ে শুতেন। তাঁর খালি মনে হতো, নায়কের মতো একেবারেই দেখতে নয় তাঁকে। এই চেহারায় কেই বা কাজ দেবেন তাঁকে। কিন্তু সেই চেহারাই হয়ে গেল তাঁর আসল ইউএসপি। শুধু নায়ক হয়ে থেকে যাননি তিনি। ইরফানের ক্যানভাস অনেক বড়।
মুম্বই পাড়ি দেওয়ার পরে একাধিক ধারাবাহিক, সিরিজে কাজ করেছেন ইরফান। তাঁর সমসাময়িক কিংবা জুনিয়ররা টিকিট টু বলিউড পেয়ে গেলেও ইরফান কিছুতেই ব্রেকথ্রু করতে পারছিলেন না। অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। নিজের যোগ্যতা নিয়ে মনে প্রশ্ন উঠছিল তাঁর। সেই সময় মীরা নায়ারের ছবি 'সালাম বম্বে'তে খুব ছোট্ট একটি চরিত্র করার প্রস্তাব পান। ভাগ্যের এমনই পরিহাস ছবির ফাইনাল কাট থেকে তাঁর অংশ বাদ পড়ে। পরের বছর বসু চট্টোপাধ্যায়ের ছবি কমলা কি মউত'-এ অভিনয় করার ডাক পান। তারপর বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। তবে ইরফানের বড় ব্রেক 'ওয়ারিয়র'। এই ছবি তাঁকে পরিচিত মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
২০০৪-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘মকবুল’ ইরফানের কেরিয়ারে অন্য ডাইমেনশন যোগ করে। এই ছবির জন্য বিশাল ভরদ্বাজের প্রথম পছন্দ ইরফান ছিলেন না। অক্ষয় কুমারকে নিয়ে এই ছবিটা বানাতে চেয়েছিলেন বিশাল। তবে ভাগ্যের পরিহাস স্ক্রিপ্ট এর মাহাত্ম্য বুঝতে না পেরে অক্ষয় ছবি ফিরিয়ে দেন। সুযোগ ছাড়েননি ইরফান। নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি।
বলিউডে প্রথম থেকেই তিনি অভিনেতা হতে চেয়েছেন। স্টার হওয়ার চেষ্টা করেনি কখনোও। মহেশ ভাটের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছেন ইরফান। এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প আছে। অভিনয় করার ধরন এতই সাবলীল তাঁকে ভাট সাহাব বলেছিলেন একটু খারাপ অভিনয় করতে। খারাপ মানে একটু অতিরঞ্জিত, মোটা দাগের কিছু করতে।
বলিউডে নিজের পা জমিয়ে ফেলেছেন, তখনই আসে বিদেশ থেকে ডাক। নেমসেক, স্লামডগ মিলিয়নিয়ার এর মতো ইংরেজি ছবিতে কাজ করেছেন ইরফান। তেলেগু এবং বাংলাদেশি ছবি ডুব-এ কাজ করেছেন ইরফান। গৌতম ঘোষের সঙ্গে ছবি করার কথা ছিল ইরফানের। হঠাৎ প্রযোজকের মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় ছবির কাজ।
ইরফানের সেরা কাজ কোন ছবিতে, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে 'পান সিং তোমার'-এ ইরফান যা করেছেন অন্য কোনো অভিনেতা করতে পারতেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ছবির শুটিং চলাকালীন একাধিকবার আহত হয়েছেন ইরফান। কখনো চোখে চোট পেয়েছেন। কখনও শিড়ধারায়। এই ছবির শুটিং করতে গিয়ে কোথাও যেন ইরফান এর যাত্রা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল পান সিং তোমারে এর যাত্রার সঙ্গে। ছবির জন্য মেলে জাতীয় পুরস্কার।
পদ্মশ্রী পুরস্কার সম্মানিত ইরফান পরের দিকের ছবিগুলোয় আরো এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। সময়ের সঙ্গে নিজেকে পাল্টাতে, সময় উপযোগী থাকতে জানেন তিনি। লাঞ্চ বক্স, পিকু মতো ছবিতে নাম ভূমিকায় না থাকলেও ইরফান ফেলেছেন নিজের সিগনেচার ছাপ। হিন্দি মিডিয়াম, করিব করিব সিঙ্গেল- এ মতো ছবিতে সামাজিক বার্তা থাকলেও ইরফান এই বার্তা দিয়েছেন এন্টারটেইনমেন্ট কোশান্ট বজায় রেখে।
তাঁর শেষ ছবি ইংরেজি মিডিয়াম লকডাউনের মাত্র কয়েক দিন আগে মুক্তি পায়। এক সপ্তাহের বেশি হলে চলার সুযোগ পায়নি এই ছবি। ছবির ট্রেইলার, গান-এ ইরফানকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল তিনি অসুস্থ। ২০১৮ থেকে ব্রেন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। চিকিৎসা চলাকালীন ইংরেজি মিডিয়ামের জন্য শুটিং করেছেন ইরফান। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি ভাল হয়ে যাবেন। তিনি আবার আগের মত কাজ করবেন। শেষ রক্ষা হলো না । ২৮ শে এপ্রিল সকালবেলা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ইরফান খান। চলে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন তাঁর সৃষ্টি করা অমূল্য সব সম্পদ।
Arunima Dey
