প্রশ্ন: ‘কেনেডি’ কেন আপনার বাকি ছবির থেকে আলাদা?
অনুরাগ: ‘কেনেডি’ এমন সময়ে বানানো, যখন আমি খুব অন্ধকার একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আর আপনারা সেই আঁধারের ছাপ ছবিতে দেখতে পাবেন খুব স্পষ্টভাবে। বাকি ছবির ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
প্রশ্ন: এখনকার বাংলা ছবি দেখা হয়?
অনুরাগ: না।
advertisement
প্রশ্ন: শেষ কোন বাংলা ছবি দেখেছেন মনে পড়ে?
অনুরাগ: শেষ দেখেছি পদাতিক। পছন্দের ছবিগুলি আমি বারবার করে দেখি। হ্যাঁ দু’টো দেখেছিলাম, অটোগ্রাফ আর টনিদার বানানো ছবিটা… রাধিকা আপ্তে ছিলেন যেটায়…
প্রশ্ন: অন্তহীন?
অনুরাগ: ঠিক ঠিক।
প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয়, স্বর্ণযুগের সময় থেকে এখনকার বাংলা ছবির মান পড়েছে?
অনুরাগ: (প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই, সপাটে…) হ্যাঁ, অবশ্যই।
প্রশ্ন: কেন?
অনুরাগ: দেখুন, আসলে না এটা গোটা পৃথিবীতেই হচ্ছে। সবকিছুরই মানে পতন হচ্ছে। এবার সব ইন্ডাস্ট্রিতেই এক অবস্থা। আমাদের হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও খারাপ কাজ হচ্ছে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে এটা চোখে বেশি পড়ে, তার কারণ এক সময়ে এই বাংলা ইন্ডাস্ট্রি সবথেকে উন্নত মানের ছবি বানিয়েছে। তাবড় তাবড় পরিচালকেরা কাজ করেছেন সে সময়। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন। কোথায় আর সেই ধরনের ছবি! তাও বলব, এমন অনেক ভাল পরিচালক আছেন, যাঁরা হয়তো সুযোগই পাচ্ছেন না। যখন থেকে তেলুগু ছবির রিমেক করা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই দুর্দিন শুরু।
প্রশ্ন: তেলুগু ছবির রিমেক?
অনুরাগ: হ্যাঁ, এখন তো ব্যবসাই সব। প্রথম সপ্তাহে একটা ছবি কেমন চলছে, তার উপর ছবির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। না চললে প্রযোজকেরা টাকা ঢালবে না তো। আমি নিজেই এই প্রবণতার শিকার। বাণিজ্যিক ছবির ব্রিগেডের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছি, যে শিল্পক্ষেত্র মধ্যমেধার মানুষদের নিয়েই চলছে। এখন কোনও ভাল সাহিত্য থেকে ভাল চিত্রনাট্য তৈরি হবে? আরে প্রযোজকই তো পাওয়া যাবে না। আমার ধারণা, মৃণাল সেন কিন্তু আজকের দিনে ছবি বানাতে পারতেন না।
প্রশ্ন: ওটিটি-র যুগে তো এমনিতেই মানুষ হলে গিয়ে ছবি দেখা কমিয়ে ফেলেছেন…
অনুরাগ: সে তো ছেড়েই দিচ্ছি, এখন মানুষ মোবাইল ফোনে ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে বা দ্বিগুণ গতি বাড়িয়ে (2x) ছবি দেখে! পরিচালকদের কষ্টটা বুঝতে পারছেন? তো এই সমস্ত কিছুই ছবির মান পতনের নেপথ্যে কাজ করে। তাই আলাদা করে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে বলছি না, কিন্তু…
প্রশ্ন: কিন্তু বাংলায় এই পতন অন্য ইন্ডাস্ট্রির তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্ট…
অনুরাগ: হ্যাঁ, একদমই তাই। আপনি যখন এক তলা বা দোতলা থেকে মাটিতে পড়বেন, তাতে যতটা আঘাত লাগবে, আর যদি সাত তলা থেকে ঝাঁপিয়ে নীচে পড়েন, সেই পতনের ধাক্কা অনেক বেশি। বাংলা আসলে চিরকালই অনেকটা উঁচুতে ছিল, তা সে ছবি হোক, নাটক হোক, পেইন্টিং হোক, সাহিত্য হোক, অথবা অন্যান্য শিল্প।
প্রশ্ন: আপনি বললেন, আপনাদের হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও মান পড়েছে। কিন্তু তাতে কি সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা ‘অ্যানিমাল’ বানিয়ে মান উন্নত করেছেন?
অনুরাগ: (হেসে) ‘অ্যানিমাল’ নিয়ে কী ভাবি… আমি তো ভেবেছিলাম, ভাঙ্গার সঙ্গে ছবি দেওয়ার অপরাধে আমাকে ক্যানসেল করে দেওয়া হবে।
প্রশ্ন: আপনার ভাল লেগেছিল ছবিটি? কয়েকদিনের মধ্যেই দু’বার দেখে ফেলেছিলেন, এদিকে দর্শকদের একাংশ ছবি দেখে বলেছেন, উগ্র পুরুষত্বকে উদযাপন করা হয়েছে।
অনুরাগ: না, আমারও অনেক অনেক জায়গা খুবই সমস্যাজনক মনে হয়েছিল। অসুবিধা হয়েছিল। আমার মাথা থেকে বেরচ্ছিল না ছবিটা। আর সেসব নিয়ে আমি সোজা ভাঙ্গার কাছেই গিয়েছিলাম। বসে বসে সমস্ত সমস্যাগুলি নিয়ে প্রশ্ন করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তিনি আমায় উত্তর দিয়েছেন। আমার ওই সততাটা ভাল লেগেছিল।
প্রশ্ন: ‘অ্যানিমাল’ আপনার কাছে ছবির জগতে ‘গেম চেঞ্জার’ কেন?
অনুরাগ: আমাদের সমাজে এমন কিছু পবিত্র সত্য রয়েছে, যা খণ্ডন করা উচিত নয় বলে মনে করা হয়। ছবি বানানোর ক্ষেত্রে পরিচালকদের উপর যেন এই ফতোয়া জারি করা আছে। কিন্তু ভাঙ্গা কোথাও গিয়ে এই কয়েকটা সত্যকে ভেঙে বেরিয়েছে। আর তাই ওই ছবি গেম চেঞ্জার। আর একদমই সেই কারণে সেই ছবিটা আমরা তিন মাস পরেও আলোচনা করে যাচ্ছি। ছবি ভাল হোক, বা খারাপ, আলোচনা হবে, এটাই কাম্য।
প্রশ্ন: ভাঙ্গার সঙ্গে ছবি দেখে আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাই (বরুণ গ্রোভার, বিক্রমাদিত্য মোতয়ানি) আপনার উপর রেগে গিয়েছিলেন। আপনাকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল…
অনুরাগ: হ্যাঁ খুবই রেগে গিয়েছিল। আমি ওদের রাগ, অভিমান নিতে প্রস্তুত। মানুষের সঙ্গে বসে কথা বলতে চাই। আমি মানুষকে ক্যানসেল করার পক্ষপাতী নই। কোনও ছবি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হলে পরিচালকের সঙ্গে বসে তাঁকে প্রশ্ন করতে রাজি। এরকম যে, কত কত ছবি আছে গোটা দুনিয়ায়, যা দেখে দর্শক বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। ‘দ্য ব্রাউন বানি’ বলে একটি ছবি হয়েছিল, যা দেখে দর্শকেরা হল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি বসে প্রশ্ন করার পক্ষপাতী। আমি মনে করি, যে ছবি মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে, সেটা আসলে ভাল কোনও কাজই করেছে।
প্রশ্ন: কিন্তু এখানেই তো বারবার প্রজেকশন এবং গ্লোরিফিকেশনের তর্কটা শুরু হয়। কোনটায় উদযাপন করা হচ্ছে, আর কোনটায় কেবল কাহিনি, চরিত্র হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে…
অনুরাগ: আসলে কী বলুন তো, ছবি হিট হওয়ার পরে না সমস্ত প্রজেকশনই গ্লোরিফিকেশনের দলে চলে যায়। আপনি ৮০, ৯০-এর দশকের ছবির কথা ভাবুন, কী হত ওখানে? এখনও তো লোকে ‘তেরে নাম’ দেখে যাচ্ছেন। অজয় দেবগন আর করিশ্মা কাপুরের ছবির ওই দৃশ্যটি দেখেননি, যেখানে নারী চরিত্রকে জুতো চাটতে বলছে পুরুষ চরিত্রটি? আমার কী মনে হয় বলুন তো, তখনও সচেতনতা অতটা বাড়েনি। তখনও জেনারেশন অতটা উওক (Woke) ছিল না।
প্রশ্ন: এখন সচেতনতা বেড়েছে, সেটা তো ভাল বিষয়…
অনুরাগ: তা তো বটেই। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে যতটা আলোচনা করা হয়, তার থেকে অনেক বেশি আলোচনা হয়েছে ‘অ্যানিমাল’ রিলিজের পর। শেষ কয়েক মাস যে পরিমাণ প্রশ্ন মানুষ তুলেছে, সেটা আগে দেখিনি। আর সেটাই প্রয়োজন। দেখুন, যেই পরিচালকেরা তাঁদের ছবির মাধ্যমে প্রশ্ন করেন না, তাঁদের আমি সুবিধাবাদী বলে মনে করি। যাঁরা ভাল পরিচালক, তাঁরা সমাজকে উস্কানি (provoke) দেবে। আর তার জন্য হয়তো সমাজ তাঁকে বারবার ক্যানসেল করবে, ক্ষোভ দেখাবে…
প্রশ্ন: আপনি নিজেই এমন একজন পরিচালক যাঁকে বারবার ক্যানসেল করা হয়েছে, ক্ষোভ দেখানো হয়েছে…
অনুরাগ: একদমই তাই। আপনি যাঁকে প্রশ্ন করছেন, তিনি একই ঘটনার শিকার। পরিচালকেরা বহু বহু যুগ ধরে সমাজকে উস্কানি (provocative content) দিয়ে চলেছেন। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বলা হত, তিনি ‘পভার্টি পর্ন’ (দারিদ্রকে যৌনতার মতো বিক্রি করা) বিক্রি করে ছবি চালাতেন। প্যাসোলিনি তো চিরকাল সংগঠিত ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে ছবি বানিয়েছেন। আর তার জন্য প্রকাশ্য রাস্তায় পরিচালককে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল। এই বাংলারই পরিচালক কিউ (Q) যেভাবে সমাজকে প্রোভোক করে, প্রশ্ন করে ছবি বানিয়ে গিয়েছেন, তার জন্য কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু আজ তাঁর ছবি বুঝে চর্চা করা হয়। আর আমি সেটাকেই সাধুবাদ জানাই।
প্রশ্ন: সমাজকে উস্কানি দিতে ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর ৩’ কবে আসবে?
অনুরাগ: কী জানি। আমি অত কিছু পরিকল্পনা করে চলি না। কিছুই ভাবিনি।
প্রশ্ন: নিজের বানানো ছবিগুলির মধ্যে আপনার দর্শক হিসেবে কোনটি পছন্দ সবথেকে বেশি?
অনুরাগ: আমার সবথেকে সৎ ছবি, ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। আজ পর্যন্ত ওটাই পছন্দের ছবি বলা যায়।