সম্ভবত এই প্রথম হিমালয় পাদদেশের এত দুর্গম অঞ্চল দিয়ে সফল হল সাইকেল অভিযান ৷ এমন আনকোরা রাস্তায় মোট ৬,২৪৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নজির স্থাপন করেছেন অ্যাডভেঞ্চার নেশারু চন্দন ৷
দুচাকায় গোটা দুনিয়া। অ্যাডভেঞ্চারের অদম্য নেশা। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও হেরে না যাবার মানসিকতা। জেদ আর অধ্যাবসায়। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক ছবির মনমোহন মিত্রের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বাহন বলতে ওই সাইকেল। ১৫৩ দিনে পাড়ি দিয়েছেন ৬,২৪৯ কিলোমিটার। বারাসতের চন্দন বিশ্বাসের মন্ত্র একটাই, চরৈবতি। স্বাধীনতা বিশ্বাসে নতুন অঙ্গীকার এই দামাল বাঙালির।
advertisement
অ্যাডভেঞ্চারই তাঁর নেশা ৷ তবে এ নেশা সর্বনাশা নয় ৷ নিজের প্রিয় দু’চাকাকেই সম্বল করে ট্রান্স হিমালয় ও সার্ক অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির উদ্দেশ্যে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার কাছে হৃদয়পুর থেকে পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, সিকিম হয়ে ভারতের ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ হয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের নুব্রা ভ্যালির হুন্ডার গ্রামে ১৮ জুলাই নিজের অভিযান শেষ করেছেন চন্দন ৷ পার হয়েছেন একশ-র ওপর নদী। যার মধ্যে গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রও রয়েছে।
পেশা সিনেম্যাটোগ্রাফি হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে ‘আরোহী’ বলেই পরিচয় দেন তিনি ৷ নেশার টানে সাইকেলে চেপে মাঝে মধ্যেই অনন্তের উদ্দেশ্যে অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন এই তরুণ ৷ এর আগে দল বেঁধে বহু অ্যাডভেঞ্চার ট্রিপে অংশ নিলেও, এরকম কঠিন রাস্তায় একক ট্রিপ এই প্রথম ৷
যাত্রাপথ ছিল অনেকটা এই রকম ৷ ঢাকা থেকে আগরতলা, শিলচর, ডিমাপুর, পাসিঘাট, তেজপুর, গুয়াহাটি হয়ে আলিপুরদুয়ার ৷ সেখান থেকে ফুংশেলিং হয়ে জলদাপাড়া, শিলিগুড়ি ৷ সেখান থেকে সোজা নেপাল ৷ কাঠমান্ডু, পোখরা, বালিয়া হয়ে ফের হরিদ্বার, দেরাদুন হয়ে রাজধানী দিল্লি ৷ সেখান থেকে শিমলা, দুর্গম রোটাং পাস, কাজা, কোকসার হয়ে যাত্রা শেষ নুব্রায় ৷
এত দীর্ঘ পথ লাগেজ নিয়ে সাইকেলে চেপে পাড়ি দেওয়া সহজ কথা নয় ৷ তার উপর রাস্তার চড়াই-উতরাই ৷ কখনও চাইলেও মেলে না পছন্দমতো খাবার ৷ তবুও কোনও কিছুর পরোয়া নেই এই বছর একত্রিশের তরুণের ৷ তবে পরিকল্পিত যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আইন-শৃঙ্খলা ৷ অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে যাত্রাপথের থেকে মায়ানপুর ও মণিপুরকে বাদ রাখতে বাধ্য হন অ্যাডভেঞ্চার বয় ৷
যাত্রাপথে কখনও ধস, কখনও বন্যার মুখোমুখিও হয়েছেন এই আরোহী ৷ অশান্ত তিব্বত সীমান্তের কাছাকাছি, যে রাস্তাটিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা বলেছেন, সেই রাস্তা দিয়েই সাইকেলে হিমাচল পেরিয়েছেন চন্দন ৷
কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা প্রশ্ন করতে না করতেই সাহসী এই যুবকের উত্তর, ‘ধরুন একটি ফাঁকা মাঠে জনাদশেক লোক বন্দুক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, ইচ্ছেমত গুলি ছুড়ছে, আপনাকে সেই মাঠটি পেরোতে হবে। অবস্থা সেরকমই। রাস্তাটি ছিল পুরোটাই স্ক্রী জোন ৷ প্রচন্ড বৃষ্টি ও হাওয়ায় শুটিং স্টোন বা রক ফলের পার্সেন্টেজ অনেক বেশী। ফুটবলারের মত ডজ করতে করতে এগোতে হয় । এই একটা পাথর পিছনে পড়ল, নাঃ বেঁচে গেলাম। আবার একটা সামনে পড়ল, নাঃ আবারও বেঁচে গেলুম।’
চন্দনের অভিজ্ঞতার তালিকা দীর্ঘ ৷ প্রায় পাঁচমাসের দীর্ঘ এক অসম্ভব জার্নির পর শারীরিকভাবে ক্লান্ত এই তরুণ সাইক্লিস্ট, কিন্তু সে ক্লান্তি মনকে স্পর্শ করেনি ৷ তাই এখনই ছকে ফেলেছেন পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা ৷ ট্রান্স হিমালয় জার্নি সফল হওয়ার পর মনের ভিতরে ফের ডাক শুনতে পেয়েছেন। আবার বেরিয়ে পড়ার ডাক। এবার হিপি ট্রেইলে ইউরোপ জয় করার অদম্য ইচ্ছেয় মনে মনে ফুটছেন চন্দন। তবে আপাতত এই মুহূর্তে অ্যাডভেঞ্চার বয় মিস করছেন তাঁর বাড়ি ৷ এবার ঘরে ফিরে মায়ের রান্না করা কাঁচকলা দিয়ে বাটা মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে ঘুমোতে চান ৷
সাহিত্য থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ডানপিটে অভিযাত্রীর অভাব নেই বাংলায়। একসময় বাঙালির বুকে ছিল কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস। বিমল মুখোপাধ্যায়ও সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণে প্রমাণ করেছিলেন। বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে কখনও প্যাডেল।