এমনিতে দেখতে গেলে বলাই যায় যে সোনার বিনিয়োগকারীরা এখন তাঁদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় কাটাচ্ছেন। নিরাপদ সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
কিন্তু হঠাৎ করে সোনার প্রতি সবার এই ভালবাসা কেন? এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ভূ-রাজনীতিকে।
২০২২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি তাদের সোনার রিজার্ভ বৃদ্ধি শুরু করার পর থেকে বিনিয়োগকারীরাও গোল্ড ইটিএফ-এর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। সোনার চাহিদা সরবরাহকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোনার দাম বেড়ে যায়।
advertisement
আরও পড়ুন: SBI vs PNB: গাড়ির লোন নিলে কোন ব্যাঙ্ক সবচেয়ে ভাল, জানুন কে সস্তায় ঋণ দিচ্ছে
২০২২ সালের অক্টোবরে রেকর্ড গড়া সোনার দাম ১,৫০০ ডলার থেকে বেড়ে আজ ৩৪০০ ডলারেরও বেশি হয়েছে। ২ বছর ৮ মাসের মধ্যে, সোনার দাম ১২৫% বেড়ে গয়েছে। গত এক বছরে সোনার দাম ৫০% এরও বেশি বেড়েছে। গত ১০ বছরে সোনার রিটার্ন প্রায় ১৮০%।
সোনার দর কি এখান থেকে আরও উপরে লাফিয়ে উঠবে? সে কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারেন না।
কিন্তু, বাজার বিশেষজ্ঞ, স্বর্ণ বিশেষজ্ঞ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অন্য বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত তাদের তরফে সোনার দামের পূর্বাভাস প্রকাশ করে। তাদের বেশিরভাগই আশা করে যে ডলারের দুর্বলতা, সম্ভাব্য শুল্ক-প্ররোচিত মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে সোনার দামে তেজ গতি অব্যাহত থাকবে।
বর্তমান তেজিবাজারে, সোনার দাম ইতিমধ্যেই ২২ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে প্রতি আউন্স ৩,৫০০ ডলারের রেকর্ড সর্বোচ্চ দাম ছুঁয়েছে, যা ঐতিহাসিক ভাবে সর্বোচ্চ তো বটেই!
সোনার এই চাহিদা আপাতত অব্যাহতই থাকবে, তবে ২০২৫ সাল এবং তার পরেও সোনার দরের নতুন লক্ষ্যমাত্রা কত হতে পারে?
কিছু ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেওয়া যাক, যারা আগামী মাস এবং বছরগুলোতে সোনার দাম কোথায় থাকবে বলে মনে করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কেন তারা এমনট মনে করে, সেটাও বুঝতে হবে।
প্রায় সকল বিশ্লেষকের মধ্যেই একটি বিষয় সাধারণ- তারা ২০২৫ সালের সোনার লক্ষ্যমাত্রা উর্ধ্বমুখী হবে এই মতই ব্যক্ত করছে!
সোনার পূর্বাভাস নিয়ে কে কী বলছে
গোল্ডম্যান শ্যাক্সের ভবিষ্যদ্বাণী হল যে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের চাহিদা দীর্ঘমেয়াদে সোনার দামকে নতুন রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে যাবে। গোল্ডম্যান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সোনার দাম প্রতি ট্রয় আউন্সে ৩,৭০০ ডলারে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা এলে ৩,৮৮০ ডলারে উন্নীত হবে।
গোল্ডম্যানের সোনার জন্য এখানে একটি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সোনার দাম প্রতি আউন্স ৪,৫০০ ডলারে পৌঁছতে পারে। এর অর্থ হল ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সোনা ৭১.৫%-এর বিস্ময়কর রিটার্ন নিয়ে বাজারে বন্ধ হতে পারে!
গোল্ডম্যানের তরফে এই অনুমানের নেপথ্যে যে কারণ দর্শানো হয়েছে, তা হল- বিনিয়োগকারীরা ক্রমবর্ধমানভাবে পোর্টফোলিওতে সোনাকে বৈচিত্র্য আনার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করার কথা বিবেচনা করবে, বিশেষ করে যদি মার্কিন ট্রেজারিগুলির মতো ঐতিহ্যবাহী ইক্যুইটি পোর্টফোলিও হেজগুলি ইক্যুইটি ড্রপডাউনের সময় খারাপ পারফর্ম করতে থাকে।
এর অর্থ হল গোল্ড ইটিএফ-এ বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ। বর্তমানে, বিশ্বব্যাপী গোল্ড ইটিএফ-এর হোল্ডিং মার্কিন ট্রেজারির মাত্র ১% এবং এসএন্ডপি ৫০০ মার্কেট ক্যাপের ০.৫%।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের সর্বশেষ তথ্য অবশ্য অন্য ছবি তুলে ধরছে। মে মাসে বিশ্বব্যাপী ভৌতভাবে সমর্থিত গোল্ড ইটিএফগুলি ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারিয়েছে, যা তাদের পাঁচ মাসের বিনিয়োগ প্রবাহকে ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু এটি স্রেফ এক মাসের পরিস্থিতি, তাও ভুললে চলবে না!
আরও পড়ুন: মাত্র ১০ বছরের SIP করবে বড়লোক, সম্পূর্ণ রিটার্ন চার্টটি বুঝে নিন, অর্ধেক ভারত এই সূত্রটি জানে না
যেদিন সোনা প্রথমবারের মতো প্রতি আউন্স ৩,৫০০ ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছিল, সেদিন জেপি মরগান ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে বেস-কেস পরিস্থিতিতে, পরের বছর সোনার দাম প্রতি আউন্স ৪,০০০ ডলারের মাইলফলকে পৌঁছাব।
তাদের যুক্তির সঙ্গে সবাই পরিচিত- বর্ধিত মার্কিন শুল্ক এবং চলমান মার্কিন-চিন বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে মন্দার সম্ভাবনা বৃদ্ধি।
জেপি মরগানের পূর্বাভাসের কয়েকদিন আগে, সিটি রিসার্চ আগামী তিন মাসের জন্য তাদের সোনার দামের লক্ষ্যমাত্রা ৩,২০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩,৫০০ ডলার প্রতি আউন্স করেছে, যার শীর্ষ কারণ ছিল চিনা বিমা কোম্পানিগুলির কাছ থেকে নতুন করে কেনাকাটা, শুল্ক ঝুঁকি, বাজারের দুর্বলতার মধ্যে নিরাপদ আশ্রয় প্রবাহ। সেই লক্ষমাত্রা ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। বাজার এখন তাই সিটি রিসার্চের কাছ থেকে একটি নতুন মূল্য লক্ষ্যমাত্রার অপেক্ষায় রয়েছে।
গোল্ড গুরুরা কে কী বলছেন
সোনায় বিনিয়োগকারীরা বিশ্ব জুড়েই গোল্ড গুরুদের দ্বারা নির্ধারিত মূল্য লক্ষ্যমাত্রার উপরেও নজর রাখেন। স্টেট স্ট্রিট গ্লোবাল অ্যাডভাইজার্সের প্রধান স্বর্ণ কৌশলবিদ জর্জ মিলিং-স্ট্যানলি এঁদের মধ্যে একজন। স্ট্যানলি পাঁচ দশক ধরে বিনিয়োগকারীদের তাঁদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে সোনার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে পেতে সহায়তা করেছেন। তিনি বিশ্বের প্রথম স্বর্ণ-সমর্থিত ETF, GLD-এর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্পষ্টতই, তিনি মূল্যবান ধাতু সম্পর্কে অনেক কিছু বোঝেন।
মিলিং-স্ট্যানলি বলেন, অনিশ্চয়তাই সোনার দাম কমার চেয়ে উর্ধ্বমুখী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। তাঁর মতে, গত বছর ফ্লোর রেট ছিল প্রতি আউন্স ২,০০০ ডলার, যা এখন প্রতি আউন্স ৩,০০০ ডলারেরও বেশি। তার তেজি পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সোনার দাম ৩,৯০০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
জন পলসন, একজন বিলিয়নেয়ার হেজ ফান্ড ম্যানেজার, সোনার উপর বাজি ধরতে চাইছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যতে মার্কিন ডলারের মান ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকবে। পলসন বিশ্বাস করেন যে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সোনা কেনা এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনার জন্য ২০২৮ সালের মধ্যে সোনার দাম প্রতি আউন্স ৫,০০০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।
চার্লি মরিস হলেন আরেকজন স্বর্ণ বিশেষজ্ঞ যিনি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে প্রথম সোনার বাজারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মাল্টি-অ্যাসেট আটলান্টিক হাউস ফান্ড ম্যানেজমেন্টের প্রাক্তন প্রধান মরিস বিশ্বাস করেন যে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির পটভূমিতে, ২০৩০ সালের মধ্যে সোনার দাম ৭,০০০ ডলারে পৌঁছতে পারে।
মরিসের বিশ্বাস, সোনার দাম আরও বাড়বে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে ডলার দুর্বল হয়ে পড়বে, পণ্যের দাম বেড়ে যাবে এবং উদীয়মান বাজারের ইক্যুইটির দাম বেড়ে যাবে, যা বন্ডকে আকর্ষণীয় করে তুলবে না এবং উন্নত দেশগুলিতে ইক্যুইটির মূল্যায়ন কমিয়ে দেবে।
ব্রিজওয়াটার অ্যাসোসিয়েটসের সহ-প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা, বিলিয়নেয়ার বিনিয়োগকারী রে ডালিও হলেন আরেকজন সুপরিচিত স্বর্ণ বিশেষজ্ঞ। ডালিওর তরফে কোনও মূল্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি, তবে মার্কিন এসইসি প্রকাশনা দেখায় যে তিনি ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বের বৃহত্তম সোনা-সমর্থিত এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড তহবিল (ETF) – SPDR গোল্ড শেয়ারের ১.১ মিলিয়ন শেয়ার কিনেছেন। এই শেয়ারের মূল্য প্রায় $৩১৯ মিলিয়ন।
বিখ্যাত লেখক এবং আর্থিক শিক্ষাবিদ রবার্ট কিয়োসাকি, যিনি তাঁর বিখ্যাত বই রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড-এর জন্য সুপরিচিত, তিনি সোনার মতো প্রকৃত সম্পদের একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যতে সোনার দাম $২৫,০০০-এ উঠতে পারে। কেন? কিয়োসাকি সর্বদা বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার দিকে ইঙ্গিত করেন এবং গত মাসে মার্কিন সরকারের ক্রেডিট রেটিং হ্রাস এবং মার্কিন ট্রেজারি সিকিউরিটিজ বিক্রয়ের বিবর্তন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
ভারতে আজ প্রতি ১০ গ্রাম ২৪ ক্যারাটের সোনার দাম ৯৭,৯৯০ টাকা। মতিলাল অসওয়াল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড সোনার দাম কমার পরও ক্রয় বজায় রেখেছে। অতএব, বিনিয়োগকারীরা ১,০৬,০০০ টাকার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রার জন্য সাপোর্ট জোনের কাছাকাছি জমায়েত শুরু করতে পারেন।
তাহলে কী করা উচিত
২০২৫ সালে সোনার দামের লক্ষ্যমাত্রা এবং প্রত্যাশা মূলত সুদের হার এবং মার্কিন ডলারের বিপরীত সম্পর্ক, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নীতি পরিবর্তন এবং মুদ্রাস্ফীতি, দেশগুলির মধ্যে চলমান যুদ্ধের মতো সংঘাতের দ্বারা প্রভাবিত হবে।
তাই মনে রাখা দরকার- দরের পূর্বাভাস এবং লক্ষ্য মূল্য বেশিরভাগই গণনা এবং অন্তর্নিহিত কারণগুলির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যা বিশ্লেষকদের একটি নির্দিষ্ট মূল্যে পৌঁছতে সাহায্য করতে পারে। ভুললে চলবে না, যখন এই কারণগুলি পরিবর্তিত হয়, তখন মূল্য লক্ষ্যমাত্রাও পরিবর্তিত হয়।
ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভিত্তি করে সোনা কেনা বা বিক্রি করার পরিবর্তে তাই এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত যা বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে মানানসই হবে এবং সেটাই মেনে চলা উচিত।
একটা বিষয় মাথায় রাখলেই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান হবে- আর্থিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য পোর্টফোলিওতে সোনা ব্যবহার করা উচিত, মূল্য লক্ষ্যমাত্রার উপর নজর রেখে নয়।