ওনমের কিংবদন্তি এবং রাজা বলি:
ওনম ঘিরে যে দুই কিংবদন্তি প্রচলিত, তার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজা বলির কথা। বলি ছিলেন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র, পিতামহের বিষ্ণুভক্তি তাঁকেও মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু বলি প্রহ্লাদের মতো নির্বিবাদী ছিলেন না। বিষ্ণুর ভক্ত হলেও দেবকুলের সঙ্গে ছিল তাঁর বৈরিতা। অতএব, দেবকুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন বলি, একে একে জয় করে নেন স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল। অতঃ পর, এই বিশাল জয়লাভের সূত্রে তিনি খ্যাতিলাভ করেন মহাবলি নামে, ঘোষণা করেন এক সুবিশাল যজ্ঞের। মহাবলির প্রতিজ্ঞাই ছিল এই- যজ্ঞ চলাকালীন কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে তিনি নিরাশ হয়ে ফিরবেন না।
advertisement
অন্য দিকে, স্বর্গ সন্তানদের হাতছাড়া হলে দেবমাতা অদিতি শুরু করেন কঠোর বর্ষব্যাপী সাধনা, যা এক কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী থেকে পরের কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এই তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু জন্মগ্রহণ করেন অদিতির সন্তানরূপে। বয়সের সঙ্গে তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি হয়নি, এই জন্য তিনি পরিচিত হন বামন রূপে।
একদা, বামন বলির যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে ত্রিপাদ ভূমি যাচনা করেন। বলি বিস্মিত হন, খর্বকায় ঋষির তিন পা ভূমি আর কতটুকুই বা হবে! কিন্তু বামন নিজের যাচনায় অটল থাকলে বলি তাঁকে ত্রিপাদ ভূমিদানে সম্মত হন। এর পরেই বামন ধারণ করেন বিরাট ত্রিবিক্রম রূপ, এক পায়ে তিনি মেপে নেন মর্ত্য, নাভি থেকে নির্গত অন্য পায়ে মেপে নেন স্বর্গ। এর পর তিনি অন্য পা কোথায় রাখবেন জানতে চাইলে বলি নিজের মাথা পেতে দেন। ত্রিবিক্রম বলেন- এই পায়ের ভারে বলি চলে যাবেন পাতালে, এবার থেকে পাতালই হবে তাঁর রাজধানী। তবে মহৎ চরিত্রের জন্য তিনি বছরে একবার বলিকে মর্ত্যে ফিরে আসার অনুমতি দেন। বলা হয়, মহাবলির এই মর্ত্যে ফিরে আসার উৎসবই হল ওনম। বর্তমানে দেশের যে অঞ্চলকে আমরা কেরল নামে চিনি, সেখানেই ছিল তাঁর রাজধানী। সূর্য সিংহ রাশিতে প্রবেশ করলে মহাবলি পাতাল থেকে উঠে আসেন, তাঁকে ফিরে পেয়ে উৎসবে আনন্দে মগ্ন হন প্রজারা।
ওনম এবং পরশুরাম:
ওনমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিষ্ণুর আরেক অবতার পরশুরামের নামও। বলা হয়, রাজা কার্তবীর্য অর্জুন এবং তাঁর সন্তানেরা পরশুরামের পিতা ঋষি জমদগ্নির কামধেনু হরণ করতে চেয়েছিলেন। বাধা দেওয়া হলে তাঁরা জমদগ্নি এবং তাঁর অন্য পুত্রদের হত্যা করেন। আশ্রমে ফিরে এসে পরশুরাম যখন এই কথা জানতে পারেন, তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে পৃথিবীকে নিষ্ক্ষত্রিয় করবেন। পরশুরাম তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণও করেছিলেন, ২১ বার পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয়দের বংশ লোপ করেছিলেন তিনি, ক্ষত্রিয়দের রক্তে স্নান করিয়েছিলেন ধরিত্রীকে। কিন্তু নিরপরাধদের হত্যার জন্য পাপও তাঁকে গ্রাস করে, বিধান দেওয়া হয় যে তা খণ্ডনের জন্য ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতে হবে। পরশুরামের নিজস্ব সম্পত্তি ছিল না, তাই তিনি জলদেবতা বরুণের কাছে ভূমি প্রার্থনা করেন। বরুণ জানান, পরশুরাম তাঁর কুঠার যত দূরে নিক্ষেপ করতে পারবেন, তত দূর সমুদ্র সরে গিয়ে তাঁর নিজস্ব রাজ্য তৈরি হবে। পরশুরামের এই ভাবে পাওয়া ভূভাগকেই বর্তমানে আমরা চিনি কেরল নামে, নতুন বসতির প্রাপ্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে কেরলের অধিবাসীরা যে নববর্ষের উৎসবের সূচনা করেছিলেন, তাকেই বলা হয় ওনম।
ওনম এবং কৃষি উৎসব:
সন্দেহ নেই, আমাদের নবান্নের মতো ওনম এক কৃষিভিত্তিক উৎসব। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে সূর্যের সিংহরাশিতে সরণ বর্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করে, এই সময়ে নতুন ধান ওঠে ভূগর্ভ ভেদ করে। রাজা মহাবলি এই ধানের রূপক এবং বামনাবতারের স্বর্গব্যাপনা সূর্যের সরণের দ্যোতক। তবে কারণ যা-ই হোক, ওনমের আনন্দ কেরলে তুলনারহিত, দশ দিন ধরে সাড়ম্বরে পালিত হয় এই উৎসব। এর মধ্যে উৎসবের সর্বাধিক জনপ্রিয় দিনটি হল তিরুবনম, চলতি বছরে যা ২১ অগাস্ট তারিখে পড়েছে। ২০ অগাস্ট রাত ৯টা ২৫ থেকে শুরু হয়ে ২১ অগাস্ট রাত ৮টা ২২ মিনিট পর্যন্ত থাকবে তিরুবনমের পুণ্য তিথি। এই দিন কেরলের অধিবাসীরা বাড়িতে ফুলের আলপনা দেন যা পুক্কালম নামে পরিচিত। ওনমের উৎসব শেষ হয় মহাবলি, স্থানীয় উচ্চারণে রাজা মাবেলিকে ওনম সাদ্য নামের এক নিরামিষ মহাভোজ দিয়ে, পায়সভোগ যার মধ্যে অন্যতম। এই অন্নভোগও নতুন চাল তথা কৃষির মাহাত্ম্যকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করে।