সত্তর বছর বয়সে এসে লড়াইয়ে ইতি টানলেন তিনি। ঠিক সেভাবে, যেভাবে তিনি একদিন দুম করে অবসর ঘোষণা করেছিলেন। অবসরের সময় তখনও হয়নি। তবুও তিনি বুটজোড়া তুলে রেখেছিলেন। কর্তাদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জন্য ওরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুরজিত্ সেনগুপ্ত। বলেন অনেকে। আসলে গোটা জীবনে বিতর্ক থেকে দূরে থেকেছেন তিনি। কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার তাঁর চরিত্রে ছিল না।
১৯৫১ সালের ৩০ অগাস্ট জন্ম সুরজিত্ সেনগুপ্তের। ময়দানে তাঁর প্রথম ক্লাব খিদিরপুর। এর পর খেলেছেন তিন প্রধানেই। ১৯৭২-৭৩-এ খেলেছেন মোহনবাগানে। তার পর ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৭৮ সালে লাল-হলুদের অধিনায়ক। ১৯৮১ সালে ফের মোহনবাগানে ফেরেন। তার আগে এক বছর খেলেছিলেন মহামেডানে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত খেলেছেন জাতীয় দলে। এমন বর্ণময় কেরিয়ার যাঁর, সেই সুরজিত্ সেনগুপ্ত ফুটবলার হিসেবে একটুও অহংকারী ছিলেন না। তবে গর্ব করতেন নিজের চরিত্র নিয়ে। ময়দানে তাঁর মতো অজাতশত্রু ফুটবলার কমই ছিলেন। ঠাণ্ডা মাথার, শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি।
সতীর্থদের আপন করে নিতে পারতেন সহজে। অধিনায়ক হিসেবে তিনি যে ইস্টবেঙ্গল দলকে বাঁধনে বেঁধে রাখতে পারবেন, সেটা দলবদলের সেই বাজারেও কর্তারা জানতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই চরিত্র বজায় রেখেছিলেন সুরজিত্ সেনগুপ্ত। কখনও কোনও বিবাদে জড়াননি। কখনও উঁচুস্বরে কথা বলেননি। কখনও কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন, সেটা তাঁর অতি বড় শত্রুও হয়তো দাবি করবে না।
মাঠে গোল করার পর কখনও তাঁকে উগ্র উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে কেউ দেখেননি। একবারই সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে গোল করে বার ধরে ঝুলে পড়েছিলেন। সেবার পঞ্জাবকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল বাংলা. শেষ গোলটা করেছিলেন সুরজিত্ সেনগুপ্ত। গোলকিপার ভাষ্কর গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পাস দেওয়ার পরই উইং ধরে ছুটেছিলেন সুরজিত্ সেনগুপ্ত। গোল এসেছিল চারটি পাসে। কিংবদন্তি পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলের কোচ। তিনি সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে আগে সুরজিত্ সেনগুপ্তকে ফোনে যা নয় তাই বলেছিলেন। বাংলার পারফরম্যান্স ভাল হচ্ছিল না বলে। পিকে বলেছিলেন, পঞ্জাবের কাছে হারলে বাংলার মান থাকবে না। পিকেকে আশ্বস্ত করেছিলেন সুরজিত্ সেনগুপ্ত। তার পর ফাইনালে গোল করে আর নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। সুরজিত্ সেনগুপ্তর বার ধরে ঝুলে পড়ার ঘটনা অনেককেই অবাক করেছিল। কারণ এমন কাণ্ড ছিল সুরজিতের স্বভাববিরুদ্ধ।
ইস্টবেঙ্গল যে সময়টাকে সোনালী অতীত হিসেবে মনে করে সেই সময় তিনি ছিলেল লাল-হলুদে। সাতের দশকের তারকা তিনি। সেই সাতের দশক, যখন বাংলার ফুটবলের আকাশ তারকাদের ছটায় জ্বলজ্বল করত। সুরজিত্ সেনগুপ্ত ক্যাপ্টেন হওয়ার পর এক সুতোয় বেঁধে রেখেছিলেন গোটা ইস্টবেঙ্গল দলকে। কর্তাদের সঙ্গে মতের অমিল হলে কখনও প্রতিক্রিয়া দেননি। কখনও বাকবিতণ্ডায় জড়াননি। সত্যি, গর্ব করার মতোই চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। ময়দানের প্রকৃত ভদ্রলোক চলে গেলেন। ময়দান যেন ফাঁকা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।