#কলকাতা: কলকাতার কোনও এক আসরে গান গাইছিলেন বেনজির বাঈ নামে এক তবায়েফ। অসাধারণ সুন্দরী, কিন্তু অতি সাধারণ মানের গায়িকা। তাঁর ধ্রুপদ, ধামার শুনে এক তারকা শিল্পী বলেছিলেন, ‘বহেন, তুম পালংপর বড়ি অচ্ছি সজোগি মগর অ্যায়সে ম্যাহ্ফিল মে বৈঠনেকা হায়সিয়ৎ তুমহারি নহি হ্যায়।’ অর্থাৎ খাটে তোমায় খুবই মানাবে, কিন্তু এমন আসরে গান গাওয়ার যোগ্যতা তোমার নেই। কী বিরাট অপমান, এমন অপমানটাই করতেন ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার গওহর জান ৷
কী হয়েছিল সেই অপমান পর্বের পর? এই অপমানে মন ভাঙাই স্বাভাবিক। বেনজির হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ট্রেন ধরে সটান দ্বারভাঙায় পৌঁছলেন। তিনি দ্বারভাঙার মহারাজের কাছেই থাকতেন। পর দিন সকালে, হাড় কাঁপানো শীতের ভোরে ওস্তাদ আজিম বক্শের দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি। ওস্তাদ দ্বারভাঙার মহারাজার গুরু। বড়ই বয়স্ক। বেনজিরকে দেখে তিনি অবাক। বেনজির কাঁদতে কাঁদতেই ওস্তাদের পায়ের কাছে নিজের গয়নার পুঁটুলি রেখে বললেন, ''আমার যা আছে, সব আপনার, কিন্তু আমায় এমন তালিম দিন যেন কলকাতার সব রহিসের সামনে গওহরের মুখে চুনকালি মাখিয়ে আসতে পারি।" ওস্তাদ প্রথমে রাজি হননি। বেনজিরের বিস্তর সাধ্যসাধনার পর বললেন, "তা চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু, বছর পাঁচেক খাটতে পারবে তো বাছা?" বেনজির এক কথায় রাজি।
পাঁচ বছর কাটল। গওহর কলকাতার এক ধনীর মুজরোয় গিয়ে শুনলেন, তাঁর আগে গাইবেন দ্বারভাঙার বেনজির বাঈ । নাম শুনে গওহর তাঁকে চিনতেও পারলেন না। তিনি গওহর জান, গোটা দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের নয়নের মণি, তাঁর বয়ে গিয়েছে এক হেঁজিপেঁজি তবায়েফের কথা মনে রাখতে। আর, মুখের ওপর অপমান তিনি প্রায় সবাইকেই করতেন, কাজেই সেই কারণেও বেনজিরকে মনে রাখার কথা নয়। যা-ই হোক, জোড়া তানপুরা নিয়ে বেনজির যা গাইলেন, তেমন সুশ্রাব্য আলাপ ও ধ্রুপদ কেউ কখনও শোনেনি। তাঁর গান শুরু হল। শুদ্ধ কল্যাণের আলাপ ও ধ্রুপদ দিয়ে আর ওই রকম চমৎকার সুরের খেলা, শ্রুতির প্রয়োগ ও মীড় সুতের লাগডাঁটে গুণিজনরা চমকে চমকে উঠলেন। তার পর রাগ আর তাল বদলে বেনজির বাঈ বেহাগে ধামার ধরলেন, বোল বাট ছন্দের কাজ হচ্ছে, আসরসুদ্ধ লোক হাতে তাল রাখছে, গওহরও দুলে দুলে মাথা নাড়ছেন।
এমন ঘন ঘন তারিফের মাঝখানে বেনজির বাঈ বলে বসলেন, "বহেন, আ যাও না অব ময়দানমে, হিম্মৎ হো তো বয়েঠকে মেরে সাথ গাও।" গওহরের গোটা জীবনে তাঁকে এমন সরাসরি চ্যালেঞ্জ খুব বেশি লোক করেননি। আর এ এমনই চ্যালেঞ্জ, যাকে জেতার মতো অস্ত্র স্বয়ং গওহরের তূণেও ছিল না।
কিন্তু, যে যুদ্ধ অস্ত্রে জেতার উপায় থাকে না, বুদ্ধি তাকে এড়িয়ে যেতে পারে। আর যা-ই হোক, বুদ্ধি, বাকচাতুর্যে গওহরের সমান তবায়েফ দেখতে আজও বাকি আছে। গওহর বেনজিরের চ্যালেঞ্জের উত্তরে বললেন, ‘বহেন হিন্দুস্থানে এখন কোনও মেয়েমানুষ নেই যে তোমার সঙ্গে বসে ধ্রুপদ ধামার গায়। আমরা তো সামান্য মানুষ ঠুংরি দাদরা গজল গাই, সে সব তো তুমি গাও না, দিল-এ চোট পেলে সে সব গান অন্তর থেকে বের হয়। সে এ সব তালিমের মুখস্থ গান নয়।’ পরাজয় স্বীকার করে নিয়েও প্রতিপক্ষকে খানিক অপমান করে যাওয়া, গওহরের আমলে যত দেখেছে কলকাতা, তার আগেও নয়, পরেও নয়। অপমান করতে ছাড়তেন না এই শিল্পী ৷ আসলে তাঁর শিল্পের অহঙ্কার গুণে অহঙ্কারী ছিলেন তিনি ৷তিনিই তো প্রথম ভারতীয় শিল্পী যাঁর গান রেকর্ড করেছিল গ্রামাফোন কোম্পানি ৷ সে সময় তাঁকে বলা হত 'বাঈজি' ৷ মেহফিল জমানো 'তবায়েফ' ৷ তবে এই পরিচয় কোনওদিন টেনে-খাঁমচে নীচে নামিয়ে আনতে পারেনি তাঁকে ৷ জন্ম ১৮৭৩-এর ২৬ জুন ৷ আজকের উত্তরপ্রদেশের আজমগঢ়ে ৷ দাদু ছিলেন ব্রিটিশ ৷ দিদিমা ভারতীয় ৷ তাঁদের মেয়ে ভিক্টোরিয়া ছোট থেকেই নাচগানে পারদর্শী ৷ হিন্দুস্তানি গান‚ কত্থক‚ ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পকলায় ছিল তাঁর অনায়াস গতি ৷ কিশোরীবেলায় ভিক্টোরিয়ার মন দেওয়া নেওয়া হল জনৈক উইলিয়াম ইওয়ার্ডের সঙ্গে ৷ আর্মেনিয়ান ইহুদি তিনি ৷ ভারতে এসেছিলেন ভাগ্যের খোঁজে ৷ কাজ করতেন শুষ্ক বরফের কারখানায়৷ বিয়ে হল উইলিয়াম-ভিক্টোরিয়ার ৷ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন জন্ম নিল একমাত্র মেয়ে‚ নাম রাখা হল অ্যাঞ্জেলিনা ইয়েওয়ার্ড ৷ তিনিই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন গওহর জান ৷ কিশোরী গওহর প্রথম অনুষ্ঠান করেন ১৮৮৭ সালে৷ দ্বারভাঙার মহারাজের আমন্ত্রণে ৷ ক’দিনের মধ্যেই তিনি হয়ে গেলেন রাজার সভাশিল্পী ৷
কয়েক বছর পর আবার স্বাধীন ভাবে পথ চলা ৷ ১৮৯৬ সালে গওহর তখন বিভিন্ন শহরে মেহফিল করছেন ৷ কাঁপাচ্ছেন গোটা দেশ ৷ এমন সময়ে জীবনে এলেন পার্সি অভিনেতা অমৃত কেশব নায়ক৷ মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণার শোক ভুলতে অমৃতের আশ্রয় খুঁজেছিলেন গওহর ৷ কিন্তি তাঁকে একা করে ১৯০৭ সালে পরলোকে চলে গেলেন অমৃত ৷ মাত্র দু-তিন বছরের সম্পর্ক‚ কিন্তু অমৃত অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছিলেন গওহরের জীবনে ৷ রাতকে রঙিন করা তবায়েফ নন, গওহর ছিলেন জাত শিল্পী ৷ ১৯১১ সালে তিনি ডাক পেলেন দিল্লি দরবারে ৷ ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের সম্মানে অনুষ্ঠানে ৷ সেখানেই ঘোষিত হল রাজধানী সরে যাবে কলকাতা থেকে দিল্লি ৷ ইলাহাবাদের জানকীবাঈয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান করলেন গওহর ৷ রাজা পঞ্চম জর্জ খুশি হয়ে এক হাজার গিনি করে নজরানা দিয়েছিলেন দুই শিল্পীকে ৷
মালকা ও গওহরের গান শুনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নেন বেগম আখতার ৷ এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি ৷ ১৯০২ সালে প্রথম ভারতীয় শিল্পীর রেকর্ড বের করল গ্রামাফোন কোম্পানি ৷ গওহর গাইলেন খেয়াল ৷ গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ফ্রেড গেইসবার্গের তত্ত্বাবধানে গান রেকর্ড করলেন গওহর ৷ এরপরেই এ দেশে বিখ্যাত হয়ে ওঠে গ্রামোফোন কোম্পানি ৷ সেই শুরু ৷ ১৯০২ থেকে ১৯২০ অবধি ১০ ভাষায় অজস্র গান রেকর্ড হয়েছে তাঁর ৷ বাংলা‚ হিন্দি‚ গুজরাতি‚ তামিল‚ মরাঠি‚ আরবি‚ পার্সি‚ পাশতু‚ ফরাসি‚ ইংরেজি…কোন ভাষায় গান গাননি তিনি ! তখন কলের গান মানেই গওহর জান ৷ প্রতি রেকর্ডের শেষে তিনি বলতেন‚‘মাই নেম ইজ গওহর জান‘৷
গওহর যে কত বড় তারকা ছিলেন‚ কত টাকা উপার্জন করেছেন‚ আবার জলের মতো উড়িয়েছেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই ৷ শোনা যায়‚ পোষা বিড়ালের বিয়ে দিতে বিশ শতকের গোড়ায় খরচ করেছিলেন বারোশো টাকা ৷ সেই মেনি যখন মা হল‚ গওহর উড়িয়ে দিলেন দু’হাজার টাকা ৷ ৪ ঘোড়ায় টানা বুগি গাড়ির জন্য ভাইসরয়কে জরিমান দিয়েছিলেন এক হাজার টাকা করে‚ প্রতিদিন | মেহফিলে তাঁর নজরানা ছিল এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা ৷ রেকর্ডিং পিছু পেতেন তিন হাজার টাকা ৷ তখনকার দিনের কোটিপতি তিনি ৷ নিয়মিত বাজী ধরতেন রেসের মাঠে ৷ একবার অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সময় তাঁর আবদারে ভাড়া করতে হয়েছিল আস্ত ট্রেন ৷ তাতে বাজনদারদের ছাড়াও গওহর নিয়ে গিয়েছিলেন নিজস্ব রাঁধুনি‚রাঁধুনির সহকারী‚হাকিম‚ধোপা‚নাপিত এবং খাস চাকর ৷
যে পুরুষকে ভোলানোই ছিল তাঁর কাজ‚ যে পুরুষের নজরানায় তাঁর এত সমৃদ্ধি‚ সেই পুরুষের জন্যই পথে দাঁড়িয়েছিলেন গওহর জান ৷ বাঈজির জীবনে বহু পুরুষ আসবে, স্বাভাবিক ৷ কিন্তু খুব কমজনই বাবু থেকে তাঁর মনের মানুষ হয়েছিলেন ৷ তাঁদের মধ্যে একজন যদি হন জমিদার নিমাই সেন‚অন্যজন তবে সৈয়দ আব্বাস ৷ বয়সে অনেক ছোট আব্বাস ছিলেন গওহরের তবলচি ৷ ভালবেসে আব্বাসকে বিয়ে করেছিলেন গওহর ৷ কিন্তু একদিন বুঝতে পারলেন স্বামীর জন্য সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন ৷ তখন তাঁর বেশিরভাগ টাকা হয় আত্মসাৎ করেছে‚নয়তো নয়ছয় করে ফেলেছে আব্বাস ৷ বিয়ে ভাঙল ৷ কিন্তু গওহরকে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন আব্বাস ৷ বহু বছর ধরে চলল মামলা ৷ গওহর জিতলেন বটে ৷ কিন্তু নামী উকিলদের পিছনে টাকা দিতে দিতে তিনি ফতুর হয়ে গিয়েছেন ততদিনে ৷ সেই গওহর তখন নিঃস্ব ৷ নেই মুজরো করার শক্তিটুকুও ৷ কিন্তু পারফর্ম না করে অন্যের বদান্যতায় বাঁচার পাত্রী ছিলেন না তিনি ৷ মাত্র দেড় বছর বেঁচেছিলেন মহীশূরে ৷ ১৯৩০-এর ১৭ জানুয়ারি চোখ বুজলেন তিনি ৷ আজ সেই গওহর জানের ১৪৫তম জন্মদিন ৷ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাল গুগল ডুডল ৷ অমর হোক শিল্পীর শিল্প।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Angelina Yeoward, Gauhar Jaan, Indian Female Superstar, গওহর জান