কলকাতার পয়লা: মহানগরে প্রথম মেয়েদের স্কুল বসল সুকিয়া স্ট্রিটের বৈঠকখানায়, পরে এর নাম হল বেথুন স্কুল
Last Updated:
#কলকাতা: সেটা ১৮০০ সালের মাঝামাঝি। সমাজ তখন একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে । অন্তপুরের পর্দা, আর রান্নাঘরের প্রবল আলোড়নের মধ্যেও অন্ধকার আকাশের বুকে বিদ্যুতের শাখা-প্রশাখার মতো দেখা যাচ্ছে তীব্র হয়ে ওঠা দু-এক ফালি আলো। সে আলো অন্তঃপুরবাসিনীদের। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউরা সে সময় একের পর এক ‘অঘটন’ ঘটিয়ে চলেছেন। ঠিক এমনই এক মহাসন্ধিক্ষণে, বাংলার নবজাগরণের মাইলফলক হিসাবে কলকাতায় গড়ে উঠল মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল।
তিনি বাঙালি নন। পুরদস্তুর সাহেব। তবু তাঁর হাত ধরেই নতুন এক দিগন্তের পথে হাঁটল কলকাতার নব্য বাঙালি সমাজ। মেয়েদের কাছে যেন রূপকথার যাদু কাঠি নিয়ে স্বয়ং দাঁড়ালেন তিনি। পুরো নাম জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। হঠাৎ বারাসাতে এক মেয়েদের স্কুল পরিদর্শনে এসে তাঁর মনে অন্য এক চিন্তা ধাক্কা দিতে থাকল। এত বড় শহর কলকাতা, সেখানে একটা মেয়েদের স্কুল হবে না? কলকাতার মেয়েরা কী তা হলে স্কুলে যাবে না? এ তো হতে পারে না।
advertisement
advertisement
সে সময় বাংলার স্বনামধন্য মুখ ছিলেন রাম গোপাল ঘোষ। বিখ্যাত বাগ্মী, সমালোচক। তাঁর কাছে গিয়েই মনের কথাটা পারলেন বেথুন সাহেব। রামগোপাল তো মহা খুশি। কিন্তু মনে দ্বন্দ্ব, সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পারবেন তো মেয়েদের ঘরের বাইরে আনতে? এমন ‘মারাত্মক’ স্বপ্নকে সফল করতে? একদিন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সভা বসালেন রাম গোপাল। সেই সভায় উপস্থিত তখনকার দিনের অন্যতম পরিবর্তপন্থী দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। সেই সভাতেই ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারও। প্রস্তাব শুনে
advertisement
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সকলে। সবার আগে দক্ষিণারঞ্জন। এক কথায় নিজের বাড়ি, লাইব্রেরি সব ছেড়ে দিতে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হল।
ততদিনে জেনানা মিশনের উদ্যোগে কলকাতায় একাধিক মেয়েদের স্কুল ছিল। কিন্তু সাধারণের জন্য তা ছিল ব্রাত্য। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা আবার স্কুলে যাবে কী? কিন্তু এই ‘গেল গেল’ রবের মধ্যেই তৈরি হল কলকাতার প্রথম মেয়েদের স্কুল। তবে সেই অর্থে এই স্কুল হয়তো প্রথম ছিল না। তবু এর জনপ্রিয়তা, প্রচার, রক্ষণশীল ও সম্ভ্রান্ত সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা- সবে মিলে এটিই সেই অর্থে প্রথম মেয়েদের স্কুলের তকমাটি ছিনিয়ে নিল।
advertisement
পুরনো বেথুন স্কুল ৷
মেয়েদের স্কুল হবে শুনে প্রথমেই দক্ষিণারঞ্জন বললেন, কী চাই? বাড়ি? সুকিয়া স্ট্রীটে আমার বৈঠকখানা আছে। এক পয়সা ভাড়া লাগবে না। সত্যিই সেই বৈঠকখানায় রমরম করে শুরু হয়ে গেল স্কুল। যদিও প্রথমে নাম ছিল ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল’। ১৮৪৯-এর ৭ মে। ২১জন ছাত্রী নিয়ে নতুন যুগের সূচনা দেখল কলকাতার মাটি।
advertisement
এ রকম মনে হতেই পারে, সেই যুগে, যেখানে জোড়াসাঁকোর জ্যোতি সারা কলকাতাকে আলোকিত করছে, সেখানে প্রথম ছাত্রী হিসেবে নিশ্চয়ই যোগ দিয়েছেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। কিন্তু না। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি উদারপন্থী ঠাকুরবাড়ি। সংস্কৃতিমনস্ক এবং স্ত্রী শিক্ষায় আগ্রহী হলেও এ ক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ি ছিল সনাতনধর্মী। মেয়েরা ঘরে বসেই পড়তে শিখত। প্রথমে বৈষ্ণবী, পরে মেমরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতেন।
advertisement
বর্তমান বেথুন স্কুল ৷
তাই লাইম লাইটের সবটুকু কেড়ে নিয়ে গেল মনদমোহন তর্কলঙ্কারের দুই মেয়ে, কুন্দমালা আর ভুবনমালা। যতটা সহজে বলা হচ্ছে, বিষয়টা ততটাও সহজ ছিল না। সমাজের একটা বড় অংশ প্রতিবাদ করল। অনেকে উৎসাহ দেখিয়েও পিছিয়ে গেল। তবু তরতর করে কলকাতা শহরের রাজপথে বেড়ে চলল বিদেশী এক সাহেবের স্বপ্ন।
advertisement
ঝড় উঠল সংবাদপত্রে। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ লিখল, ‘সরলমতি বালিকাদের স্কুলে পাঠানো উচিত নয়, তাতে ব্যভিচার সংগঠনের শঙ্কা আছে।’ শুধু তাই নয়, লেখা হল- কামাতুর পুরুষরা নাকি বালিকা বলে তাদের ছেড়ে দেবে না, কারণ খাদ্য-খাদক সম্বন্ধ।’
সে সময় নাকি একটা কথা সমাজে খুব চলছিল। লোকে বলাবলি করত, ‘বাপ রে বাপ। মেয়েছেলেকে লেখাপড়া শেখালে আর কী রক্ষে আছে? এক ‘আন’ শিখাইয়াই রক্ষে নেই। চাল আন, ডাল আন, কাপড় আন করিয়াই অস্থির করে, অন্য অক্ষরগুলো শেখালে কী আর রক্ষে থাকবে?’
২১টি ছাত্রী নিয়ে শুরু করলেও একটা সময় কমতে লাগল বেথুনের ছাত্রী সংখ্যা। এসে দাঁড়াল মোটে সাতটিতে। এদিকে সংবাদ পত্রগুলির টিপ্পুনি তো আছেই। এতদিনে ডাক পড়ল ‘ঠাকুর’কন্যার। সমাজের সমস্ত শ্রেণিকে এক ছাদের নীচে আনতে গেলে দরকার পড়ে কিছু উদাহরণের। আর এ ক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ির থেকে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে?
সাদা ফুটফুটে রং। বেণী দুলিয়ে স্কুলে পরতে এল দেবেন ঠাকুরের বড় মেয়ে। সৌদামিনী দেবী। যদিও সে অনেক পরের কথা। তার আগেই সুকিয়াস্ট্রীটের পাটাপাট উঠিয়ে ফেলেছে বেথুন স্কুল।
মেয়েদের স্কুল তৈরির বিষয়ে বরাবরই বেথুন সাহেবের প্রধান সহকারী ছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাই তিনিই হলেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্পাদক। মির্জাপুরে নিজের জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। কিন্তু সবাই বেশ ভালই বুঝল অত দূরে মেয়েদের স্কুল হলে আর একটি ছাত্রীও অবশিষ্ট থাকবে না। শেষ পর্যন্ত জমি নেওয়া হল হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে।
১৮৫০-এর ৬ নভেম্বর। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল বেথুন স্কুলের। তৎকালীন গভর্নর স্যার হার্বার্ট লিটলারের স্ত্রী বেথুন সাহেবের অনুরোধে একটি অশোক গাছ পুঁতলেন। নারী জাতির অগ্রগতির প্রতীক হিসাবে।
১৮৫১ সালের জুলাই মাসে দেবেন্দ্রনাথ মেয়ে সৌদামিনকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শুধুমাত্র দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য। তিনি জানতেন তাঁর দেখাদেখি অনেকেই আসবে স্কুলের চৌকাঠে। তাঁর অনুমান ভুল হয়নি। ধীরে ধীরে অশোক গাছের মতোই শাখা প্রশাখা ছড়াল বেথুন স্কুল। কালের গর্ব আর যুগের শৌর্য নিয়ে মাথা তুলল স্বকীয়তায়।
Location :
First Published :
April 10, 2019 3:10 PM IST