#কলকাতা: ধীরে ধীরে আশার আলো দেখতে শুরু করেছিল দেশ। বিশ্বব্যাপী মহামারীর রোষ ধীরে ধীরে কমে আসছে, তাই নিম্নমুখী দৈনিক সংক্রমণও। শুধু তা-ই নয়, লক্ষণীয় ভাবে নেমছে পজিটিভিটি রেটও। ফলে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছিল গোটা দেশের মানুষ। কিন্তু আচমকাই যেন ছন্দপতন!
হাজির হয়েছে মারণ করোনাভাইরাসের (Coronavirus) নতুন এক ভ্যারিয়ান্ট, ওমিক্রন (Omicron)। আশঙ্কার কালো মেঘ দেখতে শুরু করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization)-ও। সেই কারণে বিভিন্ন দেশে নতুন করে বিধিনিষেধের কঠোর নিয়ম জারি করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকেই একদিন বাড়িতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, এটা কী ভাবে সম্ভব?
দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বৎসোয়ানায় উৎপত্তি হয়েছে ওমিক্রন ভ্যারিয়ান্টের। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষের শরীরেও মিলেছে এই বিপজ্জনক ভ্যারিয়ান্টের হদিশ। বলা হচ্ছে, ডেল্টা (Delta) ভ্যারিয়ান্টের তুলনায় করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়ান্ট অনেক বেশি ভয়ানক এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সার্স-সিওভি-২ ভ্যারিয়ান্ট কীভাবে বেড়েই চলেছে?
বিশ্বব্যাপী মহামারির তিন বছর হতে চলেছে। কিন্তু এর মধ্যেই আমরা দেখতে পেয়েছি এই মারণ ভাইরাসের নানান রকম ভ্যারিয়ান্ট। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে যে, এই ভ্যারিয়ান্ট বাড়ছে কী কারণে? আসলে ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করে নিজের প্রতিলিপি (Copy) বানিয়ে ফেলে, যাতে কোষে কোষে অনুপ্রবেশ করতে পারে। আর এই পদ্ধতি চলাকালীন ভাইরাস আরও সমর্থ হয়ে ওঠে। হার্ভার্ড গেজেটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, ‘মিউটেশন হল ভাইরাসের জীবনচক্রের স্বাভাবিক দিক’। তবে যে ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, তার মিউটেশন কিন্তু দু’মুখো তরবারির মতোই বিপজ্জনক। আরও সহজ ভাবে বললে ব্যাপারটা দাঁড়াবে, মিউটেশনের ফলে অন্যকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা কমতে শুরু করে, কিন্তু জিনগত বা জেনেটিক পরিবর্তনের কারণেই তা দ্রুত হারে সংক্রামক হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এক জনের দেহ থেকে অন্য জনের দেহে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মিউটেশন আসলে ভাইরাসের বিপজ্জনক রূপ। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা জানাচ্ছেন যে, সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রতি মাসেই ১-২ নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন জমা হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য আরএনএ ভাইরাসের তুলনায় এ ক্ষেত্রে মিউটেশনের হার কম।
আর যখনই কোনও ভাইরাসের মিউটেশন শুরু হয়, তখন সেই ভাইরাসের রূপ তার প্রকৃত রূপের থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। তখনই বলা হয় যে, নতুন একটি ভ্যারিয়ান্ট চলে এসেছে। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর বিশ্লেষণ, একটা ভ্যারিয়ান্টের এক অথবা একাধিক মিউটেশন থাকতে পারে এবং সেটা ওই ভাইরাসের অন্যান্য ভ্যারিয়ান্টের তুলনায় আলাদা।
আবার ব্রিটেনের কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা, বেশির ভাগ মিউটেশনই কিন্তু গুরুত্বহীন। তবে তার মধ্যে কিছু মিউটেশন কখনও কখনও ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে।
ভ্যারিয়ান্টগুলি কী ভাবে অ্যান্টিবডিগুলি এড়িয়ে চলে?
বিভিন্ন ভ্যারিয়ান্ট নিয়ে অতটাও উদ্বেগ থাকতো না। তবে অ্যান্টিবডি দ্বারা প্রাপ্ত সুরক্ষাকবচ ভেঙে ফেলার ক্ষমতা রাখে কিছু কিছু ভ্যারিয়ান্ট। আসলে ভ্যাকসিন নেওয়া হলে অথবা আগের সংক্রমণের কারণে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেই অ্যান্টিবডিও ভেদ করতে পারে কয়েকটি ভ্যারিয়ান্ট। ফলে সেগুলোই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে ভ্যারিয়ান্ট সংক্রান্ত একটি তালিকা রয়েছে। ভ্যারিয়ান্টকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভ্যারিয়ান্টস অফ ইন্টারেস্ট (VoIs) এবং ভ্যারিয়ান্টস অফ কনসার্ন (VoCs)। সাধারণত এই ধরনের ভ্যারিয়ান্টই ইমিউন সিস্টেমের উপর আঘাত হানতে সক্ষম। এ বার যে প্রশ্নটা আসে, সেটা হল- ভ্যারিয়ান্ট বাড়তে থাকলে তা পুরোপুরি ভাবে অ্যান্টিবডিগুলিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, সেই জায়গায় পৌঁছতে গেলে ভ্যারিয়ান্টকে অনেক বার মিউটেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। রকাফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান যে, করোনা সংক্রমণ অথবা ভ্যাকসিন থেকে এক ব্যক্তির দেহে যে পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেই পরিমাণ অ্যান্টিবডি প্রতিরোধী হতে গেলে ভবিষ্যতে সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসকে অন্তত পক্ষে ২০ বার মিউটেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আর এখানেই ওমিক্রন (B.1.1.529) উদ্বেগের অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। আসলে এই ভ্যারিয়ান্ট এখনও পর্যন্ত ৩০ রকম মিউটেশন করতে পেরেছে। বিটা (B.1.351) এবং ডেল্টা (B.1.617.2) ভ্যারিয়ান্টের সঙ্গেও এই ভ্যারিয়ান্ট কিছু মিউটেশন শেয়ার করে। তবে বিশেষজ্ঞরা এ-ও জানিয়েছেন যে, ভাইরাস কতটা কার্যকরী অথবা এর প্রভাব কতটা, সেই বিষয়গুলি চিহ্নিত করতে পারে না স্বতন্ত্র মিউটেশনগুলি।
সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়ান্ট প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ দলটি জানাচ্ছে, প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হল- অন্যান্য ভ্যারিয়ান্টের তুলনায় এ ক্ষেত্রে পুনঃসংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি।
ভ্যাকসিন কি আদৌ কার্যকর?
যাঁদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাঁদের পক্ষে কার্যকর ভাবে ভাইরাসের সঙ্গে যুঝে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ে। এর ফলে ভাইরাস শরীরের মধ্যেই থেকে যায় এবং তা প্রতিলিপি বানিয়ে বা রেপ্লিকেট করে একটা নতুন আকার ধারণ করে। তাই যাঁরা ভ্যাকসিন নিয়েছেন অথবা যাঁরা এক বার এই রোগে আক্রান্ত হয়ে সেরেও উঠেছেন, তাঁরা আবার এই ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্ত হতে পারেন। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ-এর একটি রিপোর্টে আমেরিকায় আক্রান্তদের সংখ্যার বিষয়ে বলা হয়েছে। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, খুব অল্প সংখ্যক টিকাপ্রাপ্ত মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং তার থেকেও অল্প সংখ্যক মানুষ এই রোগ সংক্রান্ত জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। টিকাপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ হলেও উপসর্গ সাধারণত মৃদু থাকে অথবা উপসর্গহীনও থাকতে পারে। এমনকী দেখা গিয়েছে যে, যাঁরা টিকার ডোজ সম্পূর্ণ করেছেন, তাঁদের থেকে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনাও অনেকটাই কম। যাঁরা এখনও পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হননি অথবা ভ্যাকসিন নেননি, তাঁদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যার কারণে ভাইরাস নিজের প্রতিলিপি বানাতে থাকে, আর এর জেরে নতুন ভ্যারিয়ান্ট বৃদ্ধির রাস্তাও প্রশস্ত হয়।
ওমিক্রন এবং অন্যান্য ভ্যারিয়ান্টের হাত থেকে বাঁচতে কী কী করণীয়?
বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন যে, কোভিড ১৯ প্যান্ডেমিক পর্যায় থেকে এন্ডেমিক পর্যায়ে ঢুকতে শুরু করে দিয়েছে। যার অর্থ হল, এই রোগ জনসংখ্যার মধ্যে এই রোগ থেকে যাবে, কিন্তু কেস বেড়ে যাওয়ার ঘটনা কমে যাবে। আরও সহজ ভাবে বলতে গেলে কোভিড অনেকটা মরসুমি ফ্লুয়ের মতো রোগ হিসেবে থেকে যাবে। কিন্তু এই ধরনের বিপজ্জনক ভ্যারিয়ান্ট উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। কারণ অ্যান্টিবডি ভেদ করতে এরা সক্ষম এবং এদের কারণে মারাত্মক উপসর্গও দেখা দিতে পারে। হার্ভার্ড গেজেটকে এক বিশেষজ্ঞ জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্পাইক প্রোটিনে একগুচ্ছ পরিবর্তনই চিন্তার কারণ। আসলে এর ফলে মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপিগুলি অথবা ভ্যাকসিনের দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতার উপর প্রভাব পড়বে।
এ দিকে আবার, আফ্রিকাতেই বেড়ে উঠেছে ওমিক্রন। যেখানকার প্রতিটি দেশেই ভ্যাকসিনেশনের জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। সেখানে আবারও প্রমাণিত হল, ভ্যাকসিন কতটা প্রয়োজন! শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের প্রগতিশীল দেশগুলি ইতিমধ্যেই বুস্টার ডোজ দিতে শুরু করেছে। এ বার সেই বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তাও প্রকট হয়ে উঠছে।
ভ্যাকসিনেশনের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন ভ্যারিয়ান্টের উপর নজরদারি চালানোর বিষয়েও জোর দিচ্ছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা। এ দিকে আবার হার্ভার্ড গেজেট বলছে, অ্যান্টিবডি-ভিত্তিক থেরাপি এবং ভ্যাকসিন এমন ভাবে তৈরি করতে হবে, যা সরাসরি ভাবে স্পাইক প্রোটিনকে আক্রমণ করতে পারে। তাই বিজ্ঞানীদের এমন কিছু থেরাপি আনতে হবে, যেটা অ্যান্টিবডি ইমিউনিটির থেকেও অনেকাংশে বেশি। সেই সঙ্গে ওই থেরাপির মধ্যে তথাকথিত সেলুলার ইমিউনিটির বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Omicron