হোম /খবর /Explained /
অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারে আতঙ্কিত চিকিৎসক-মহল, সামনেই ওঁত পেতে বিপদ

Antibiotics overuse: অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারে আতঙ্কিত চিকিৎসক-মহল, সামনেই ওঁত পেতে বিপদ

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বলতে যা বোঝায়, তা হল- কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া

  • Share this:

#কলকাতা: স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (Sir Alexander Fleming) নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে নোবেল মঞ্চে তিনি বলেছিলেন, “একটা সময় আসবে, যখন প্রতিটা দোকানে পেনিসিলিন বিক্রি হবে এবং যে-কেউ সেটা কিনতেও পারবেন। এর পরেই আসবে আসল বিপদ। আসলে এই ডোজ নেওয়ার ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে শরীরের রোগজীবাণুগুলো ওষুধের অ-প্রাণঘাতী কোয়ান্টিটির সংস্পর্শে আসবে। যার জেরে এই ড্রাগের ক্ষেত্রে তাঁরা রেজিস্ট্যান্ট হয়ে পড়বেন।” কে জানতেন, ছিয়াত্তর বছর আগে করা ফ্লেমিংয়ের এই ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যি হয়ে যাবে!

এ বার চলে আসি বর্তমান সময়ে। আজ ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে ডাক্তাররা আমাদের অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সও যে সারা বিশ্বে চোখ রাঙাচ্ছে, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসক মহল।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বলতে কী বোঝায়?

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বলতে আসলে যে বিষয়টা বোঝায়, সেটা হল- কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া উচিত নয়। এ ছাড়া বারবার পুরনো প্রেসক্রিপশন ব্যবহার করা, ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রাইব করা ডোজ সম্পূর্ণ না-করা, প্রেসক্রাইব করা ডোজ সঠিক পরিমাণে না-নেওয়া এবং সময়মতো ডোজ না-খাওয়া- এই সব কারণকেও অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার হিসেবে গণ্য করা হয়।

ইদানীং মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা বাড়ছে। কোনও রকম সংক্রমণ হলে ওষুধের দোকানে পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে অথবা ওষুধের দোকানে জিজ্ঞেস করেই মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে ফেলা হচ্ছে। তার পর কয়েক দিনের মধ্যে ফের সংক্রমণ হলে আবার সেই ওষুধের দোকানে জিজ্ঞেস করেই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলেন কেউ কেউ। আমরা নিজেদের দিয়েই তো দেখতে পাই। আসলে আমরা সামান্য সর্দি-কাশি-জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে না-গিয়ে অনেক সময়ই ওষুধের দোকানে জিজ্ঞেস করে যথেচ্ছ ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেয়ে ফেলি। এটা কিন্তু একেবারেই ভুল। আর এতেই ঘনিয়ে আসছে বিপদ, কারণ এ ভাবে ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে পড়ছে মানুষ। এটা শুধু আমাদের দেশ নয়, এটা সারা বিশ্বেরই অন্যতম বড় সমস্যা। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিষয়টা আসলে কী? এর অর্থ হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক আর নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার উপর কাজ করতে পারছে না। অর্থাৎ ক্ষমতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। আসলে আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনও গাইডলাইন নেই, তাই সকলেই অ্যান্টিবায়োটিক হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছেন। আর এটাই ডেকে আনছে বিপদ।

কেন সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি?

কোচির অমৃতা হাসপাতালের ডিভিশন অফ ইনফেকশাস ডিজিজেস-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. কিরণ জি কুলিরানকালের বিশ্লেষণ, “অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র মানুষের জীবনই বাঁচায়নি, সেই সঙ্গে ওষুধ এবং অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে উন্নতিসাধনও ঘটিয়েছে। অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিক আমূল বদল এনে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আগে নানাবিধ সংক্রমণের জেরে মানুষের মৃত্যু ঘটতো, এমনকী কম বয়সেই মারা যেত মানুষ। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক আসার পরে সেই মৃত্যু হার অনেকটাই কমে গিয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়ে গিয়েছে জীবনের গড় মেয়াদকাল। কিন্তু যথেচ্ছ ভাবে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বিপদ ডেকে আনছে। আসলে এই বিষয়টাই রেজিস্ট্যান্স বিবর্তনের পথ সুগম করে দিচ্ছে। ভুলভাল প্রেসক্রিপশনের জন্যও তৈরি হচ্ছে বহু প্রতিরোধী জীব। গৃহপালিত পশুদের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের কারণেও ড্রাগ প্রতিরোধী ব্যকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে। ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক এবং নিয়ন্ত্রক বাধার কারণে খুবই কম পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা গিয়েছে।”

এর পাশাপাশি তিনি আরও যোগ করেন, ফার্স্ট এবং সেকেন্ড লাইন অ্যান্টিবায়োটিক ট্রিটমেন্টের বিকল্পের ক্ষেত্রে বাধার উদ্ভব হওয়ার কারণে পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীরা রিজার্ভ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে বাধ্য হন। আর এই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বেশ দামি এবং এর নানান ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে বটে!

এএমআর বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) ক্রাইসিস:

জরুরিকালীন ভাবে এএমআর-এর বিষয়ে নজর দেওয়ার উপর জোর দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization)। সেই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে যে, এএমআর হল বিশ্বের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা প্রথম দশের মধ্যেই রয়েছে। যা সমগ্র মানবজাতির জন্য বিপজ্জনক। ফাইজার লিমিটেডের মেডিক্যাল ডিরেক্টর ডা. সোনালি দিঘে-র মতে, “২০১৭ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় সাত লক্ষ মানুষ এএমআর-এ মারা যান। আর যদি এখনই সচেতন না-হওয়া যায়, কিংবা কোনও পদক্ষেপ না-করা হয়, তা হলে এই মৃত্যুর সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে ২০৫০ সালে দশ লক্ষে গিয়ে ঠেকবে। অর্থাৎ ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর এএমআর-এ প্রায় দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটবে। শুধু তা-ই নয়, এই এএমআর-এর কারণে বার্ষিক জিডিপি-ও প্রায় ৩.৮ শতাংশ কমে যাবে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ এএমআর-এ প্রতি বছর ভারতেই প্রায় দুই লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটবে।”

সোনালি আরও যোগ করেন, ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিআই (Klebsiella pneumoniae), অ্যাসিনেটোব্যাক্টর (Acinetobacter), সিউডোমোনাস (Pseudomonas)-এর মতো কিছু প্যাথোজেন স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সংক্রমণ ঘটানোর জন্য দায়ী। আর এ ক্ষেত্রে দিন দিন সমস্যা বাড়ছে, কারণ এর চিকিৎসা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, নানান ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া হলেও এই ধরনের সমস্যা দূর করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এগুলি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। আসলে কার্বাপেনেমস (Carbapenems) এবং থার্ড জেনারেশন সেফালোস্পোরিনস্ (Cephalosporins)-এর মতো অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। আর ওই প্যাথোজেনগুলি এই সব অ্যান্টিবায়োটিককেও প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে।

ভারত-সহ সারা বিশ্বে অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল বিষয়ের উপর নজরদারি চালিয়ে ফাইজার পুরোপুরি ভাবে অনুসন্ধানযোগ্য একটি ডেটাবেস বানিয়েছে। আর সেটাই হল-- এটিএলএস বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল টেস্টিং লিডারশিপ এবং সাইভেইল্যান্স (ATLAS)। নানান ধরনের ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধের ধরন এবং এই সব ব্যাকটেরিয়ার উপর কোন অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করতে পারবে, এই সব বিষয়গুলি বুঝতে সাহায্য করবে এই ডেটাবেস। ক্লিনিশিয়ান, নার্স এবং ফার্মাসিস্টদের জন্য কিছু শিক্ষামূলক প্রোগ্রামও আনা হয়েছে, যাতে হাসপাতালে হাসপাতালে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল স্টুয়ার্ডশিপ বাস্তবায়িত করা যায়।

এই মুহূর্তে যেটা সবার আগে প্রয়োজন, সেটা হল- হেলথকেয়ার ওয়ার্কারদের সঠিক ট্রেনিং। জনসাধারণের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রেসক্রিপশন এবং বিনা প্রয়োজনে মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য ঠিকঠাক ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দোকানে দোকানে অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং বৈধ প্রেসক্রিপশন থাকলে তবেই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা- এই সংক্রান্ত আইন আনতে হবে। আর এই সব পদক্ষেপ করলে তবেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের মতো গুরুতর সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।

Published by:Rukmini Mazumder
First published:

Tags: Antibiotic