আমি তারে পারি না এড়াতে... শূন্য মনে হয়... নিজের মুদ্রাদোষে একা শশী আর ইতিকথার পুতুলদের গল্প
- Published by:Rachana Majumder
- news18 bangla
Last Updated:
নিজেই নিজের অদৃষ্ট রচনা করে, তারই ক্রীতদাস হয়ে নিজের মুদ্রাদোষে একা হয়ে গিয়েছে। কখনও হয়েছে পুতুলনাচের দর্শক, কখনও নিজেই পুতুল।
‘খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে হারু ঘোষ দাঁড়াইয়াছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে তাকিয়া কটাক্ষ করিলেন…’ মৃত্যু দিয়ে উপন্যাস শুরু করেছিলেন মানিক। মৃত্যু দিয়েই ছবি শুরু করলেন পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। ‘আকাশের দেবতার দিগন্ত কাঁপানো হুঙ্কারে’ শুরু হল পুতুলনাচের ইতিকথা। মানিক লিখছেন, ‘হারুকে সহজে এখানে কেউ আবিষ্কার করিবে, এরূপ সম্ভাবনা কম।’ সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে গা হারুর চারপাশে কচুপাতায় আটকানো জলের রুপোলি রূপ আর অচেনা দ্বীপের মতো হারুকে আবিষ্কার করল শশী। মৃত্যুর হাত ধরে দর্শকের পরিচয় হল শশী (আবীর চট্টোপাধ্যায়)-র সঙ্গে।
শশী। শশী ডাক্তার। আমাদের ‘ছোটবাবু’। শশী চেয়েছিল জীবনটাকে উপভোগ্য করে তুলতে। পারেনি। চেয়েছিল গাওদিয়া ছেড়ে শহরে যেতে। পারেনি। বন্ধু কুমুদের বোহেমিয়ান জীবনকে মনে মনে ঈর্ষা করেছে, কামনা করেছে, পারেনি। গ্রামের শ্রীহীনতা, অজ্ঞতাকে পদাঘাত করতে চেয়েছে, পায়নি। গ্রামজুড়ে যখন শুধুই মৃত্যু আর শূন্যতা, তখন সেই গেঁয়ো মানুষগুলোর ডাক্তারি করতে করতে নিয়তি কিংবা অদৃষ্টের হাতের পুতুল হয়ে থেকে গেছে শশী। ’পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’
advertisement
পরানের বউ কুসুম (জয়া আহসান) ভালবেসেছিল শশীকে। শরীরে, মনে। ছলে-বলে-কৌশলে তার কাছে আসতে চেয়েছিল। বুঝেও বোঝেনি শশী। কুসুমের দুর্বোধ্য আকর্ষণকে তাচ্ছিল্য করেছে। তার ডাকে সাড়া দেয়নি। যখন উপলব্ধি করেছে কুসুমের ব্যাকুলতাকে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কুসুম যেভাবে শশীর সাধের গোলাপচারা মারিয়েছিল, তার থেকেও নিষ্ঠুর শক্তিতে শশী মারিয়ে গিয়েছে কুসুমের আকর্ষণকে। আমাদের গেঁয়ো অথচ বিচক্ষণ কুসুম, আমাদের ‘পরাণের বৌ’ তার ছোটবাবুর শোয়ার ঘর দেখতে চেয়েছিল। প্রশ্ন উসকে দিয়েছিল, ‘এ ঘরে আপনি একা শোন ছোটবাবু?’ হয়তো সেই সাজানো সাম্রাজ্য়ের অধীশ্বরী হতে চেয়েছিল। অথবা পেতে চেয়েছিল শুধুই শশীকে। শশীর ডাক্তারি স্টেথোস্কোপ কুসুমের হৃদস্পন্দন ধরতে পারেনি। ‘ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
advertisement
advertisement
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে…’
ছবিতে কুসুমের প্রায় শেষ সংলাপ ‘কাকে ডাকছেন ছোটবাবু কে যাবে আপনার সঙ্গে কুসুম কি বেঁচে আছে সে মরে গেছে।’ আধো-বালিকা আধো-রমণী জীবনীশক্তিতে ভরপুর কুসুমকে দিঘির জলে স্নান করিয়ে তার সব জীবনীশক্তি কেড়ে নিয়েছেন পরিচালক। শশীকে না দেখিয়া এখন কুসুমের দিন কাটিবে, শশী বাদ দিয়া কাটিবে জীবন। ’পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’
advertisement
গ্রন্থের আরও দুই খণ্ডাংশ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সিনেমাতেও অনুরূপ। সেনদিদি-যামিনী কবিরাজ (সুব্রতনাথ মুখোপাধ্য়ায়) এবং যাদব পন্ডিত-পাগলা দিদির সাব-প্লট। রূপ ছিল যাঁর অহংকার, অদৃষ্টের পুতুল হয়ে সেই রূপ খোয়ালেন সেনদিদি (অনন্যা চট্টোপাধ্য়ায়)। খোয়ালেন এ জগৎ সংসারকে দেখার দৃষ্টি। ’পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’
চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি যাঁর প্রবল অনাস্থা, সেই যাদব পন্ডিত (ধৃতিমান চট্টোপাধ্য়ায়) কে স্বেচ্ছামৃত্যু প্রমাণ করার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানেরই সাহায্য নিতে হয়। এড়াতে পারেন না তিনিও। চিকিৎসাকে ঘৃণা করা যাদব পন্ডিত নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে যান হাসপাতালের খাতে। ’পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’
advertisement
আজ আমরা পুতুলনাচের ইতিকথা চলচিত্রের কথা বলতে বসেছিলাম। বলতে বলতে তলিয়ে গেছি উপন্যাসের অন্তস্থলে। তেমনটাই করেছেন পরিচালক স্বয়ং। মানিকের পুতুলনাচ আর সুমনের পুতুল নাচ কোথাও আলাদা নয়। ভাবে, ভাবনায়, আঙ্গিকে গঠনে সুনিপুণভাবে পরিচালক ছুঁয়ে গেছেন লেখককে। কোথাও বাহুল্য নেই, অতিরঞ্জন নেই। এমনকী সাঙ্গীতিক মূর্চ্ছনার মধ্যেও রয়েছে এক অদ্ভুত চেতনাপ্রবাহ রীতি। ছবিতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে একটি নেকড়ে। হতে পারে সে অদৃষ্ট, হতে পারে সে নিয়তি, হতে পারে শশীর ভবিতব্য কিংবা দোলাচলতা। হতে পারে প্রতিবন্ধকতা, বাঁধন। যে বাঁধন বারাবার পথ আটকে দিয়েছে শশীর।
advertisement
শশীর বোন বিন্দুর দাম্পত্যজীবন বা তার অস্বাভাবিকত্বের প্রসঙ্গ আনেননি পরিচালক। কুমুদ (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়)-মতি (সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়)র পূর্বরাগ, অনুরাগ, দাম্পত্য জীবনের যাযাবরত্ব এনেছেন বটে, তবে তাদের পরিণতি দেখান নি। হয়তো দেখাতে চাননি। কুমুদের অস্থিরতা, যাযাবরত্ব, ঔদাসীন্যকে মেনে নিয়েই তাকে বিয়ে করেছে মতি। তবে তার ভাগ্যপরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেননি পরিচালক। মানিক নিজে বলেছিলেন, ‘ওদের কথা এই খানেই শেষ হইল। যদি বলিতে হয় ভিন্ন বই লিখিয়া বলিব। এক্ষেত্রেও লেখকের ছায়াই অণুসরণ করেছেন পরিচালক।’ ছবিতে বিচ্ছেদের প্রতীক রূপে বারাবার ফিরে এসেছে নৌকা। একে একে চলে গেছে মতি, কুসুম, সেন দিদি, যাদব পন্ডিত, পাগলা দিদি, যামিনী কবিরাজ। চলে গিয়েছে শশীর বাবাও। শশীর দাপুটে বাবা গোপাল দাস (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) নিজের আদিম রিপুর কাছে হেরে, ভাগ্যের ক্রীতদাস হয়ে সেনদিদির সন্তানকে নিয়ে সেও চলে গেল গাওদিয়া ছেড়ে। সামাজিক, সম্পর্ক, দায়িত্ব সব দিয়ে গেল শশীকে। যে তালবন সাক্ষী ছিল কুসুমের উচ্ছ্বলতার, সেই তালবন আজ নিস্তব্ধ। টিলার একপ্রান্তে শশী অপর প্রান্তে নেকড়ে।
advertisement
’পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’ শশীর উত্তর ছিল, ‘তাকে একবার হাতে পেলে দেখে নিতাম। শশী পারেনি। নিজেই নিজের অদৃষ্ট রচনা করে, তারই ক্রীতদাস হয়ে নিজের মুদ্রাদোষে একা হয়ে গিয়েছে। কখনও হয়েছে পুতুলনাচের দর্শক, কখনও নিজেই পুতুল।
বিনোদন জগতের লেটেস্ট সব খবর ( Entertainment News in Bengali ) পান নিউজ 18 বাংলায় ৷ বলিউড, টলিউড থেকে হলিউড সব খবরই পাবেন এখানে ৷ দেখুন ব্রেকিং নিউজ এবং টপ হেডলাইন ন নিউজ 18 বাংলার লাইভ টিভিতে ৷ এর পাশাপাশি ডাউনলোড করতে পারেন নিউজ 18 বাংলার অ্যাপ অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস-এ ৷ News18 Bangla-কে গুগলে ফলো করতে ক্লিক করুন এখানে ৷
Location :
Kolkata [Calcutta],Kolkata,West Bengal
First Published :
August 06, 2025 7:47 PM IST