কাজ নেই মৃৎশিল্পীদের, স্মৃতির তালিকায় উঠতে চলেছে ছাঁচের লক্ষী গণেশ
Last Updated:
আর কয়েক যুগ পরেই হয়তো হারিয়ে যাবে একটি গোটা শিল্পি গোষ্ঠী। মৃৎশিল্পীদের পরের প্রজন্ম আর মাটিতে হাত দিচ্ছেন না। পয়লা বৈশাখের আগে ছাঁচের লক্ষ্মী গণেশের খোঁজে গিয়ে উঠে এল রূঢ় বাস্তবের এমনই এক চিত্র!
#কলকাতা: আর কয়েক যুগ পরেই হয়তো হারিয়ে যাবে একটি গোটা শিল্পি গোষ্ঠী। মৃৎশিল্পীদের পরের প্রজন্ম আর মাটিতে হাত দিচ্ছেন না। পয়লা বৈশাখের আগে ছাঁচের লক্ষ্মী গণেশের খোঁজে গিয়ে উঠে এল রূঢ় বাস্তবের এমনই এক চিত্র!
২০১৮-র কুমোরটুলি। রাস্তার দু'পাশে সারি সারি দোকান। মাটির পুতুল- দেবতাদের ছড়াছড়ি। একটা দোকানে, এক দোহারা চেহাড়ার ভদ্রলোক বসে মাটির তাল মাখছেন।
--''দাদা, ছাঁচের লক্ষী গণেশ কোথায় তৈরি হয় বলত পারেন?'' চকচকিয়ে উঠল ভদ্রলোকের চোখ-- ''বড় অর্ডার আছে নাকী?''
advertisement
''না, ওই একটু কথা বলার ছিল।''
খানিক নিরাশ হয়ে, উদাশ গলায় বললেন, '' এখানে তো এখন আর তেমন ছাঁচের কাজ হয় না! এগিয়ে যান! সামনে দু-চার ঘর আছে। ওরা ছাঁচের কাজ করে।"
advertisement
খানিক এগোতেই দেখা মিলল, বছর সত্তরের এক বৃদ্ধের। ছাঁচের গণেশ বানাতে ব্যস্ত। ঘরে একটা ছোট্ট ৬০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। জিজ্ঞেস করলাম, ''এখানে নাকি আজকাল আর তেমন ছাঁচের কাজ হয় না?
চশমার আড়াল থেকে একবার দেখলেন বৃদ্ধ,
ঠিকই শুনেছেন। আমার নাম কানু পাল। আমি আর আমার ভাইপো এই কাজ করি। ওদিকে আরও দু-তিন ঘর আছে। এখন আর কেউ ছাঁচের কাজ করতে চায় না। সবাই বড় ঠাকুর বানায়। ছাঁচের কাজে তেমন পয়সা কই? ৫০ টাকার ২০০ পিস ঠাকুর বানালাম। বিক্রি হল মাত্র ১০০ পিস। লস তো হলই, সেইসঙ্গে ওগুলোকে ভেঙে যে আবার কাজ করব, তাও হয় না। মাটিটা নষ্ট হয়ে যায়।

advertisement
ইতিমধ্যে, আশেপাশে জড়ো হয়েছেন আরও ৫-৬ জন। তাঁদের মধ্যেই একজন, নাম শ্যামল পাল ওরফে ভোলা জানালেন,
এ'বছর সরস্বতী ঠাকুর বানিয়ে বিশাল ক্ষতি হয়েছে। আমরা যে ক'জন ছাঁচের কাজ করি, সবার ঘরে এখনও গাদা করে মূর্তি পড়ে রয়েছে। মাটি কেনার টাকা, রং, কয়লা সবই প্রায় বেকার গেল। ভাবছি এবার ছেড়ে দেব! এ'বছর শুধু যে ক'পিস লক্ষ্মী-গণেশের অর্ডার পেয়েছি, সেটাই করছি। দত্তবাড়ি, চন্দ্রবাড়ি, কেসি দাসের বাড়ি, বাপি গেঞ্জির বাড়ি-- ওঁরা সবাই আমার থেকেই ঠাকুর কেনেন।

advertisement
তা হলে কী কুমোরটুলি থেকে ছাঁচের কাজ হারিয়েই যাবে? ''দেখুন, কুমোরটুলিতে ছাঁচের কাজ শুরু করেছিলেন আমাদের বাপ-ঠাকুরদাই। তাঁদের মধ্যে তেঁতুল পালই প্রথম এই কাজ করেন। তারপর আমরা আসি। এখানে আমরা যে'কয় ঘর শিল্পী আছি, সবাই-ই নদীয়া জেলার। ঘর বাড়ি ছেড়ে এখানে নতুন বসতি গড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েরা আর কেউ মাটিতে হাত দেয় না। আমরাও জোর করি না। কেন চাইব বলুন আমাদের মতো ওদেরও অভাবের মুখে পড়তে হোক!'' বললেন শ্যামলবাবু।
advertisement
গ্রাম থেকে নতুন কারিগর এই কুমোরটুলিতে আসেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা কেউ ছাঁচের কাজ করতে চান না। সবাই বড় কাজই করে। কাজেই, এখন কুমোরটুলিতে ছাঁচের কাজের শিল্পী বলতে এই ক'টা ঘর। দুর্গাপুজো, কালিপুজো, লক্ষ্মীপুজোতে কিছু কাজ থাকে! কিন্তু তাও বুঝেশুনে মূর্তি বানান। ভয়! যদি বিক্রি না হয়! আজকাল এখানে বিয়েবাড়ির কাজও হচ্ছে। ওখানে সাজানোর জন্য অনেক পুতুল তৈরি হয়। ফাইবারের কাজ। লোকজন মাটির থেকে সেদিকেই ঝুঁকছে বেশি। কীই বা করবে? পয়সাও তো বেশি!
advertisement
এতক্ষণে, ওই জটলার মধ্যে থেকে একজন জানালেন ভরসার কথা,
ব্যঙ্ক থেকে প্রতি বছর ব্যবসা করার জন্য আমাদের লোন দেওয়া হয়। এক বছরের মধ্যে সেটা খুব কম সুদ সমেত ফেরত দিতে হয়। এইটা একটা বড় সুবিধা।

কিন্তু শুধু কুমোরটুলির ছাঁচশিল্পই কি ধুঁকছে? কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাকি শিল্পীদেরও কি একই অবস্থা? খোঁজ করতে করতে কালিঘাট। ১৫-১৬ ঘর ছাঁচের শিল্পী থাকেন এখানে। দেখা পাওয়া গেল পিন্টু পালের। আদি বাড়ি উত্তরপ্রদেশ। তাঁর ঠাকুরদাই ৭০ বছর আগে এখানে প্রথম ছাঁচের কাজ শুরু করেন। বছর চল্লিশের পিন্টুর চেহাড়ায় বয়সের ছাপ একটু বেশিই পড়েছে। বললেন,
আমরাও আর পারছি না ছাঁচের কাজ করতে। একদম রোজগার হয় না। এক ভারী মাটি কিনতে ১০ হাজার টাকা লাগে। তারপর আরও খরচা রয়েছে। এদিকে বিক্রি নেই! আমাদের ছেলে-মেয়েরা আর কেউ এই কাজে আসছে না। আমরা ব্যঙ্ক থেকে লোনও পাই না। ওটা শুধু কুমোরটুলির শিল্পীরাই পায়।

advertisement
আর বেশিক্ষণ থাকা যাচ্ছিল না। কানু পাল, ভোলা পাল, পিন্টু পালেরা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কলকাতার বুকের এক গভীর ক্ষতকে। কোনওরকমে গলি থেকে বেরিয়ে সোজা অটোয় রাসবিহারী। তখনও কানে ভাসছিল সেই করুণ আর্তি, '' দিদি, ছাঁচের লক্ষ্মী গণেশের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও হারিয়ে যাব না তো...!''
.quote-box { font-size: 18px; line-height: 28px; color: #767676; padding: 15px 0 0 90px; width:70%; margin:auto; position: relative; font-style: italic; font-weight: bold; }
.quote-box img { position: absolute; top: 0; left: 30px; width: 50px; }
.special-text { font-size: 18px; line-height: 28px; color: #505050; margin: 20px 40px 0px 100px; border-left: 8px solid #ee1b24; padding: 10px 10px 10px 30px; font-style: italic; font-weight: bold; }
.quote-box .quote-nam{font-size:16px; color:#5f5f5f; padding-top:30px; text-align:right; font-weight:normal}
.quote-box .quote-nam span{font-weight:bold; color:#ee1b24}
@media only screen and (max-width:740px) {
.quote-box {font-size: 16px; line-height: 24px; color: #505050; margin-top: 30px; padding: 0px 20px 0px 45px; position: relative; font-style: italic; font-weight: bold; }
.special-text{font-size:18px; line-height:28px; color:#505050; margin:20px 40px 0px 20px; border-left:8px solid #ee1b24; padding:10px 10px 10px 15px; font-style:italic; font-weight:bold}
.quote-box img{width:30px; left:6px}
.quote-box .quote-nam{font-size:16px; color:#5f5f5f; padding-top:30px; text-align:right; font-weight:normal}
.quote-box .quote-nam span{font-weight:bold; color:#ee1b24}
}
Location :
First Published :
April 10, 2018 1:11 PM IST