কথিত আছে পাঠান আক্রমণ থেকে বিষ্ণুপুর-সহ গোটা মল্লগড়কে রক্ষা করেছিলেন মহারাজ। তিনি রাঢ়বঙ্গে পাঠান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং মুন্ডমালার ঘাটের যুদ্ধ-সহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পাঠানদের পরাজিত করে রাঢ়বঙ্গে স্বাধীন সনাতন ধর্মীয় রাজ্য মল্লভূম জনপদের অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রাখেন। তবে শুধু যুদ্ধ নয়, বীর হাম্বির ব্যক্তি হিসাবে ছিলেন এক ধার্মিক, জ্ঞানী এবং বিদুষী পুরুষ। শোনা যায় তখনকার দিনে রাজসভায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় বসত পুঁথিপাঠ এবং গ্রন্থ আলোচনার আসর। সেই কারণেই প্রাচীন এই পুঁথিগুলিকে রাজজ্যোতিষী অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন মহারাজের কাছে। জ্যোতিষীর মুখে অমূল্য সম্পদের কথা শুনে মহারাজ বীর হাম্বীর সেই সম্পদ লুঠ করার নির্দেশ দেন। এক শীতের সন্ধ্যায় বিষ্ণুপুর সংলগ্ন মালিয়াড়ার কাছে রাজার সেনাদের মুখে পড়ে ১৪টি গরুর গাড়ি। এই গরুর গাড়িগুলিতে বেশ কিছু প্রাচীন পুঁথি নিয়ে বৃন্দাবন আর উদ্দেশ্যে পণ্ডিত শ্রীনিবাস আচার্য। সঙ্গে ছিলেন আরও বেশকিছু বৈষ্ণব।
advertisement
আরও পড়ুন: ডোমজুড়ের গ্রামের ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ৭ লক্ষ টাকা পুরস্কার! সঙ্গে আবার স্কুটি, ফ্রিজ, আলমারি
রাজার নির্দেশে সেনারা লুঠ করে সেই প্রাচীন পুঁথিগুলি। এরপর কেটে যায় বেশ কিছু দিন। একদিকে অমূল্য সম্পদে পরিপূর্ণ হয় মল্লরাজ্ বীর হাম্বিরের কোষাগার। অন্যদিকে পুঁথিগুলি উদ্ধার না হওয়া অবধি বিষ্ণুপুর ছেড়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শ্রীনিবাস আচার্য। তাই পুঁথির সন্ধানে বিষ্ণুপুর জনপদ ঘুরতে ঘুরতে এক সন্ধ্যায় দেউল গ্রামের কাছে শ্রীনিবাস আচার্যের সঙ্গে দেখা হয় এক ব্রাহ্মণের। তিনিই আচার্যদেবকে বলেন, তার লুঠ হয়ে যাওয়া পুঁথি রয়েছে মহারাজের কোষাগার অলংকৃত করে এবং বর্তমানে সেই পুঁথিই পাঠ হচ্ছে রাজসভায়। ব্রাহ্মণের কথামতো শ্রীনিবাস আচার্য এসে উপস্থিত হন এই রাজসভায়। তখন বির হাম্বীর-সহ বেশকিছু শ্রোতাদের উপস্থিতিতে বসে পুঁথিপাঠের আসর। শ্রোতারা সব মন প্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেও পুঁথির ব্যাখ্যা শুনে মন বসেনি শ্রীনিবাস আচার্যের। তিনি মনে মনে সাহস যুগিয়ে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে গিয়ে শ্রীনিবাস আচার্য স্ব-প্রতিভ গলায় রাজ পণ্ডিতকে বললেন পুঁথিপাঠ অসাধারণ হলেও তার ব্যাখ্যায় রয়েছে কিছু খামতি। এই কথা শুনে মহারাজ বীর হাম্বির নিজে শ্রীনিবাস আচার্যকে পুঁথির ব্যাখ্যা করতে অনুরোধ করেন। শুরু হয় এক মনোমুগ্ধকর পুঁথিপাঠ।
আপনার শহরের হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের নামের তালিকা পেতে এখানে Click করুন
কথিত আছে বেশ কয়েকদিন ধরেই মহারাজ-সহ অন্যসব শ্রোতারা পারিপার্শ্বিক সব কিছু ভুলে শ্রীনিবাস আচার্যের পুঁথিপাঠ শোনেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। সেই মায়া জড়ানো কণ্ঠ সেই সাবলীল ব্যাখ্যা আজও যেন শোনা যায় এই মল্লভূম বিষ্ণুপুরের আনাচে কানাচে। শ্রীনিবাস আচার্যের পুঁথিপাঠ শুনেই মহারাজ বীর হাম্বির তার পরিচয় জানতে চান। এবং পরিচয়-সহ তিনি জানতে পারেন কোষাগার পরিপূর্ণ করে থাকা অমূল্য এই পুঁথিগুলি আসলে শ্রীনিবাস আচার্যের। কান্নায় ভেঙে পড়ে মহারাজ এবং আচার্যের পায়ে লুটিয়ে পড়েন এবং তিনি বলেন ‘আমিই সেই মহাচোর’ যে আপনার অমূল্য সম্পদ লুঠ করেছে। মহারাজের স্বীকারোক্তি শুনে মুগ্ধ হন আচার্য ঠাকুর এবং তিনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন মল্লরাজ বির হাম্বিরকে।
বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে আরও ধার্মিক হয়ে পড়েন মহারাজ। বিষ্ণুপুরের বুকে সুবিশাল রাজপ্রাসাদ নয় একে একে তিনি গড়ে তোলেন নানা মন্দির। কোথাও টেরাকোটা, কোথাও আবার ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে নগরের সমস্ত প্রান্তে গড়ে ওঠে একচুড় এবং পঞ্চচূড় মন্দির। সময়ের সঙ্গে শুধুমাত্র রাজপরিবার নয় গোটা বিষ্ণুপুর বৈষ্ণব ভাবাবেগে উন্নীত হয়। গড়ে ওঠে কীর্তন দল। বিভিন্ন মন্দিরে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হন লালজিউ মদন গোপাল, মদনমোহন, শ্যমরায় সহ একাধিক বিগ্রহ। কৃষ্ণ লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবনের সুদুরেই যেন গড়ে ওঠে আরেক বৃন্দাবনে। আর এই সব কারণেই বিষ্ণুপুরকে বৃন্দাবনের সঙ্গে তুলনা করা হয়।





