প্রশ্ন : অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চিনের অবস্থান কী?
মোহন গুরুস্বামী: চিন কখনও অরুণাচল অধিকারে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। আমি একবার লাসার (Lhasa) একটি ট্র্যাভেল এজেন্ট অফিসে একটি মানচিত্র দেখেছি। সেই অনুযায়ী শুধুমাত্র তাওয়াং লাইনকেই চিনের সীমান্ত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে অন্যান্য মানচিত্রে সীমান্ত নিয়ে একাধিক অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। সেই সূত্রে অরুণাচল প্রদেশের একটা বিরাট এলাকাকেই চিনের একটা অংশ হিসেবে দাবি করা হয়।
advertisement
প্রশ্ন: তিব্বতের এলাকা নিয়ে চিনের দাবি কী?
মোহন গুরুস্বামী: চিনের দাবি অনুযায়ী, তাসাং লাসা থেকে পরিচালিত হয়েছিল। এবং এই তাৎপর্যপূর্ণ এলাকা তিব্বতের আধ্যাত্মিক ও আঞ্চলিক শাসক দলাই লামার প্রতি অনুগত ছিল। আর ঠিক এই ভিত্তিতেই অঞ্চলটির উপরেএকটা দাবি জন্ম নেয়। তবে এখনও চিনকে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তিব্বত ও দার্জিলিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিকিম। কিন্তু পরে তা জোর করে নিয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরা। এই যুক্তি খাড়া করে সিকিম ও দার্জিলিং নিয়েও একটা দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু ইতিহাসও বদলেছে। সময় বদলেছে। তাই এই নিয়ে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রশ্ন: এক্ষেত্রে ভারতের পূর্বের অবস্থান কী ছিল?
মোহন গুরুস্বামী: এই জটিলতার মাঝে বড় প্রশ্ন হল দু'টি দেশের জাতীয় পরিচয়। তারা কখন, কী ভাবে বিকশিত হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গও উঠে আসে। মুঘলদের সাম্রাজ্য আফগানিস্তান থেকে বাংলায় বিস্তৃত ছিল। তবে দক্ষিণে গোদাবরীর নিচের দিকে খুব একটা বিস্তার লাভ করেনি। অন্য দিকে, ব্রিটিশ ভারতে আজকের ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ একত্রিত ছিল। তবে আফগানিস্তান ছিল না। ১৮২৬ সালে প্রথমবার অসমকে ভারতে নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশরা। তখন তারা বর্মাকে পরাজিত করেছিল।
প্রশ্ন: ব্রিটিশদের পদক্ষেপে কি চিনের কোনও বিরোধিতা ছিল?
মোহন গুরুস্বামী: ১৮৮৬ সাল। ব্রিটিশরা প্রথমে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বেরিয়ে আসে। তখন তারা লোহিত উপত্যকায় নতুন চা বাগানে অভিযান চালায়। স্পষ্টতই অঞ্চলটি চিন বা তিব্বত কারও অধীনে ছিল না। কারণ দলাই লামা বা চিনের আম্বান থেকে কোনও প্রতিবাদ দেখা যায়নি।
প্রশ্ন: তিব্বত ও লাসার আত্মপ্রকাশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
মোহন গুরুস্বামী: ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে লাসা সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সময় এক পণ্ডিত সম্প্রদায় ভারতের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র দাসের তিব্বতের উপরে বইগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: তিব্বতের সঙ্গে ব্রিটিশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কোন পর্যায়ে ছিল?
মোহন গুরুস্বামী: ১৯০৩ সালে কার্জন তিব্বতে একটি সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গোর্খা ও টমিজের একটি শক্তিশালী বাহিনী নাথুলা পেরিয়ে চুম্বি উপত্যকায় চলে যায়। সেখানে একটি তিব্বতীয় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনারা তাদের উপরে গুলি বৃষ্টি করলেও, প্রত্যুত্তরে গুলি চালানো হয়নি। কোথাও যেন জালিয়ানওয়ালাবাগের স্মৃতি উসকে দেয়।
প্রশ্ন: তিব্বতকে কী ভাবে দেখা হয়েছিল? কেন আলাদা করা হয়েছিল তিব্বতকে?
মোহন গুরুস্বামী: ১৯০৭ সাল। ব্রিটেন ও রাশিয়া আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্মত হয়। সেই সময়ে তিব্বতকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ১৯০৭ সালে তৎকালীন রাশিয়া সেনাবাহিনীর কর্নেল ম্যানারহেইম (Mannerheim), পরে ফিল্ড মার্শাল ম্যানারহেইম এবং ফিনল্যান্ডের প্রথম রাষ্ট্রপতি অশ্বারোহীদের পথ চিহ্নিত করার জন্য কিরগিজস্তান থেকে চীনের উত্তর-পূর্বে হারবিনে ঘোড়ার পিঠে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
প্রশ্ন: এই সূত্র ধরেই কি সিমলা সম্মেলন?
মোহন গুরুস্বামী: গুরুত্বপূর্ণ বছর হল ১৯১৩। সেই সময়ে কিং রাজবংশের পতন ও চিনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল তিব্বত। এই সময়ে নাথু লা-র মধ্য দিয়ে চিনের সেনার উপরে হামলা হয়। ১৯১৩ সালে ভারত-তিব্বত সীমানা নির্ধারণের জন্য ব্রিটিশরা সিমলা সম্মেলন ডেকেছিল। ১৯১৪ সালে ম্যাকমাহন লাইনের প্রস্তাব করেছিল ব্রিটিশরা। পরে তিব্বত তা গ্রহণ করে নেয়।
প্রশ্ন: এই পটভূমিতে দলাই লামার অবস্থান ঠিক কী ছিল?
মোহন গুরুস্বামী: ১৯৩৫ সাল। স্যার ওলাফ ক্যারো ICS, তৎকালীন বিদেশ মন্ত্রকের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন। তখনও ম্যাকমাহন লাইনের বিষয়টি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৪৪ সালে জে পি মিলস ICS ব্রিটিশ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করতে যান। তবে তাওয়াং বাদ পড়ে যায়। এর মূল কারণ ছিল অসমের গভর্নর হেনরি টুইনাম (Henry Twynam) তিব্বতকে উস্কানি দিতে চাননি। ১৯৪৭ সালে দালাই লামা সদ্য স্বাধীন ভারতকে নেফার (NEFA) তথা অরুণাচলের কয়েকটি জেলার দাবিতে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: অদূর ভবিষ্যতে কি এই সমস্যা মিটে যেতে পারে?
মোহন গুরুস্বামী: ১৯৫০ সালের অক্টোবরে চিন তিব্বত সীমান্তের সাতটি স্থানে আক্রমণ করে। তারা যে সমস্ত অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়, সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যুত্তর মেলে ১৯৫১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। মেজর রিলেঙ্গনাও ‘বব’ খাতিং তাইওয়াংয়ে ভারতের পতাকা ওড়ান। এই প্রসঙ্গের মূল উদ্দেশ্যটি হল, অরুণাচল প্রদেশের প্রতি ভারতের দাবিও কোনও ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপরে গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশদের সূত্রেই সেখানে ভারতের অনুপ্রবেশ। প্রায় এক শতক হয়ে গিয়েছে, তবে এখনও সমস্যা জারি।
প্রশ্ন: অরুণাচল প্রদেশকে কী নজরে দেখছেন?
মোহন গুরুস্বামী: অরুণাচল প্রদেশের জনসংখ্যার মিশ্রণ বেশ আকর্ষণীয়। জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও কম তিব্বতের মানুষজন। জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ হল ইন্দো-মঙ্গোলয়েড উপজাতির মানুষজন। বাকিরা নাগাল্যান্ড এবং অসম থেকে আসা বাসিন্দা। ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দুরা ৩৭ শতাংশ, ৩৬ শতাংশ অ্যানিমিস্ট, ১৩ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সাম্প্রতিক আদমসুমারির পরিসংখ্যান বলছে, খ্রিস্টান মানুষজনের সংখ্যা বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২১টি বড় উপজাতি গোষ্ঠী এবং ১০০টিরও অধিক জাতিগত ভাবে পৃথক উপ-গোষ্ঠী রয়েছে, ৫০টিরও বেশি স্বতন্ত্র ভাষা ও উপভাষায় কথা বলা হয়। প্রায় এক মিলিয়ন জনসংখ্যা ১৭টি শহর এবং ৩, ৬৪৯টি গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতে সীমান্ত নিয়ে বোঝাপড়া শুরু হলে, ম্যাকমোহন লাইনের উত্তরে থাকা কয়েকটি মনপা গ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কি সরব হতে পারে ভারত?
মোহন গুরুস্বামী: বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, হুয়াংপো বা ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণে পেমাকো ঘাট থেকে দক্ষিণ দিকের অরুণাচলের সুবানসিরি ডিভিশনে প্রবেশ পর্যন্ত একটি যথাযথ সীমানা থাকার কথা। এই অঞ্চলে চিনের প্রশাসনিক উপস্থিতি খুব একটা দেখা যাবে না। তাই ভারত মনপা গ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করার পথে হাঁটতে পারে।
প্রশ্ন: ভারতের সঙ্গে তিব্বতের যোগ নিয়ে কী বলবেন?
মোহন গুরুস্বামী: এটা সত্যি যে, ঐতিহাসিকভাবে তিব্বতের সঙ্গে ভারতের কোনও সরাসরি সীমানা ছিল না। পরের দিকে অর্থাৎ ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশরা নেপাল থেকে কুমায়ুন ও গাড়ওয়াল অধিকার করে নেওয়ার পরে এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ১৮৮৬ সালে অরুণাচল প্রদেশের দিকে জায়গাটির পরিসর বাড়তে থাকে। অন্য দিকে, হিমালয় সর্বদা সাংস্কৃতিক ভাবে ভারতের একটি অংশ ছিল। পাশাপাশি তিব্বত বা চিন যে-ই হোক না উত্তরের কোনও শক্তি থেকে রক্ষার জন্য একটি প্রাকৃতিক বাধা হিসেবেও কাজ করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে। এর জেরে প্রতিকূল দুর্গম অঞ্চলেও নিজেদের বিজয় পতাকা ওড়াচ্ছে মানবজাতি। এখন আর হিমালয় সেই মাত্রার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়ে নেই। বলা বাহুল্য, চিন ও ভারত বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক শক্তির পাশাপাশি ক্ষমতাশালী দেশ। বর্তমানে তাই পুরো পরিস্থিতি নির্ভর করছে দুই দেশের কূটনৈতিক রণনীতির উপরে।
প্রশ্ন: এই পরিস্থিতির সঙ্গে চিনের ইতিহাসের কী যোগ রয়েছে?
মোহন গুরুস্বামী: সতেরো শতক থেকে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে চিনে তখন মাঞ্চুর রাজত্বকাল ছিল। তাঁদেরও একটা প্রবণতা ছিল। সেই সময়ে সামরিক ও প্রতিরক্ষাগত কারণে সীমান্তের সামনে থাকা জমিগুলিতে নিজেদের দাবি জাহির করার বিষয় লক্ষ্য করা যেত। China Review ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে অধ্যাপক জি জিয়ানজিওং লিখেছেন, ট্যাংয়ের রাজত্বকালে তিব্বতের ওই অংশকে নিজেদের হিসেবে দাবি করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। তিনি আরও জানিয়েছেন, ১৯১২ সালের আগে অর্থাৎ চিন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্তও চিনের ধারণা স্পষ্ট হয়নি।
অধ্যাপক জি (Ge)-এর কথায়, গ্রেটার চায়না-র ধারণা পুরোপুরি কিং কোর্ট রেকর্ডের একতরফা মতামতের উপরে ভিত্তি করেই তৈরি। যা রীতিমতো বাড়াবাড়ি করেই লেখা হয়েছিল। কোথাও যেন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, যে বা যাঁরা চিনের সীমান্ত অঞ্চল যত বেশি বাড়িয়ে তুলবেন, তিনি তত বড় দেশপ্রেমিক। এই সূত্রে সম্প্রতি ভারতের তৎকালীন চীন রাষ্ট্রদূত সান ইউক্সির (Sun Yuxi) সঙ্গে কথোপকথনের একটি প্রসঙ্গ তুলে আনা যায়। সেই সময়ে রাষ্ট্রদূত সান বলেছিলেন, ভারতে তাঁর অনিচ্ছাকৃত মন্তব্যের জন্য চিনে সুবিধা মিলেছিল। জি জিয়ানজিওংয়ের (Ge Jianxiong) পরামর্শ, চিন যদি সত্যিই শান্তিপূর্ণ ভাবে এগিয়ে যেতে চায় এবং ভবিষ্যতে দৃঢ় পদক্ষেপ করতে চায়, তবে অবশ্যই ইতিহাসকে উপলব্ধি করতে হবে এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে।