মনে পড়ে হেয়ালিটা? ১৯৭৯ তে মু্ক্তি। দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত চার দশক। বাঙালি তবু আজও বুঁদ সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ বা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ। বাঙালির শৈশবের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলুদা। অস্কারজয়ী সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সেই ফেলুদা সিরিজেরই দ্বিতীয় মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত, উৎপল দত্ত, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে সেই সময়ে অভিনয়ে পাল্লা দিয়েছিলেন এক খুদে অভিনেতা। কে বলবে, সেটাই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো তাঁর! সিনেমার শুরুতেই ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে ফেলুদা, জটায়ু, তপসেদের দিকে বন্দুক তাক করার সিন-টা তো বাঙালির শৈশবের নস্টালজিয়া। মিস্টার পারফেক্ট ফেলুদাও পাশে দাঁড়ানো জটায়ুকে সেই চরিত্রের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘ও ছেলে আমাদের কথা শুনবে না।’’
advertisement
ঠিক ধরেছেন। ক্যাপ্টেন স্পার্কের কথাই বলছি। ওরফে রুক্মিনি কুমার। কাশির ঘোষাল বাড়ির ছোট ছেলে। মগনলাল মেঘরাজকে প্রথম দর্শনেই ডাকু গন্ডারিয়া ঠাওরে বসে যে ছেলে! গোয়েন্দাদের কেস-হিস্ট্রি যার ঠোঁটের গোড়ায়। ফেলুদাকে যে ছেলে অবলীলায় প্রশ্ন করতে পারে,‘‘তোমার রিভলভার আছে?’’
রুক্মিনী কুমার। বয়স বড়জোর সাত। সত্যজিৎ রায়ের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ জাঁকিয়ে অভিনয়ের পরে সিলভার স্ক্রিনে আর দেখা যায়নি দুষ্টু-মিষ্টি সেই বাচ্চাটাকে। কলকাতা থেকে বহু দূরে কর্মসূত্রে এখন চেন্নাইয়ে থাকেন রুকু। চুলে পাক ধরেছে। বহু চেষ্টার পর নম্বর জোগাড় করে চেন্নাইয়ে যোগাযোগ করতেই ওপার থেকে রাশভারি গলায় ভেসে এল ‘হ্যালো’। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-র সেই ছোট্ট রুকু এখন কর্পোরেট জগতের বড় অফিসার। দক্ষিণের নামী হোটেল চেনের মার্কেটিং প্রধান। সময়ের হিসেবে একচল্লিশ বছরেরও আগের ঘটনা। তবু শ্যুটিংয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই অনর্গল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর রুক্মিনী কুমার ওরফে বাস্তবের জিৎ বোস। চেন্নাইয়ে কর্পোরেট মিটিং সারার ফাঁকেই উচ্ছ্বসিত জিৎ। বলছিলেন,‘‘সে এক লাইফ টাইম অভিজ্ঞতা। দশ দিনের মতো ছিলাম কাশিতে। মনেই হয়নি শ্যুটিং করছি। মাণিকজেঠু খুব মজা করেই কাজটা বার করে নিতেন।’’
সেদিনের রুকু আজকের প্রৌঢ় কর্পোরেট অফিসার। কলকাতা আসেন কখনও সখনও। শহরে এলে একবার অবশ্য সন্দীপ রায়ের সঙ্গে দেখা করবেনই। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর পর আর রুপালি পর্দায় দেখা গেল না কেন? স্মৃতি হাতড়ে অতীতে ফিরে গেলেন জিৎ বোস। রুকু হিসেবে তাকে চূড়ান্ত করার ঘটনায় আজও দেদার মজা পান জিৎ বোস। ‘‘ আমি থাকতাম লেক মার্কেটের কাছে। টালিগঞ্জে মামার বাড়ি গিযেছিলাম। সেখানেই রাস্তায় আমায় দেখেন মাণিকজেঠুর ক্যামেরাক্রিউ পুণু সেন। পরদিন বাবার সঙ্গে মাণিকজেঠুর বাড়িতে গিয়ে লুকটেস্ট। তারপরেই সব ফাইনাল।’’ একটু থেমে আবার যোগ করলেন,‘‘তখন আমি স্কুলে। শ্যুটিংয়ের জন্য যাতে আমার লেখাপড়ার ক্ষতি না হয় সেটা ভেবে আমার শ্যুটিং সিডিউল ফেলা হয়েছিল স্কুল ভেকেশনের সময়।’’কাশিতে আউটডোর শ্যুটিংয়ের সময় চোখের সামনে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত, উৎপল দত্তদের দেখে থতমত খেতেন না? হাসতে হাসতে সহজ উত্তর রুকুর,‘‘তখন তো অত জ্ঞানই হয়নি। অত কিছু বুঝতেই পারতাম না। ছাদের ওপর আলসেতে দাঁড়িয়ে বন্দুক ছোঁড়ার দৃশ্যেও আমার থেকে বেশি চিন্তায় ছিল ইউনিটের লোকজনের। মনে আছে, রেলিংয়ের ধারে কাঠের প্ল্যাটফর্ম ফেলা হয়েছিল। আর সেটে আমার জন্য বরাদ্দ ছিল মুঠো লজেন্স।’’ বিপদে পড়েছিলাম অন্যভাবে। শ্যুটিং চলাকালীন কাশিতে আমার দুধের দাঁত পড়ে গিয়েছিল। আমার মাপের নকল দাঁত আনতে প্রোডাকশন ইউনিটের সে এক দক্ষযজ্ঞ। বড় বড় হেয়ালি, ধাঁধা! ওই বয়সে মনে রেখে ক্যামেরার সামনে বলতেন কী করে? আবার হাসতে শুরু করেন দক্ষিণের কর্পোরেট বস। হাসতে হাসতেই উত্তর,‘‘ আপনি যেটা ভাবছেন সে রকম কিছু হয়নি। সমস্যা হয়েছিল ছাদের ঘরে একটা কান্নার দৃশ্যে। আমার চোখে কিছুতেই জল আসছে না। এদিকে শটের পর শট। শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সামনে দাঁড়ালেন মাণিকজেঠু।গম্ভীর রাশভারি গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী অসুবিধে হচ্ছে। ব্যাস, চোখে জল আসতে আর দেরি হয়নি। নেক্সট শটেই ওকে।’’
PARADIP GHOSH
