ঋতুর ছবি সেই সময় কথা বলতে শুরু করে যখন বাংলা ছবি 'তোমার ঠোঁট দুটো কমলা লেবুর কোয়া'! সত্যজিৎ তো কবেই শেষ। ফেলুদা তখন আর আসেন না। তখন আসেন পাড়ার ভাইরা। কিম্বা বউমারা। অঞ্জন চৌধুরির হাত ধরে মেজ বউ, সেজ বউ, ছোট বউ এসবের মাঝে একটা দুটো প্রভাত রায়। কিম্বা অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এসেছে বইকি। কিন্তু সে শান্তির জল মুখে তোলার আগেই হাতে শুকিয়ে গিয়েছে। তারপর আবার স্বপন সাহা। তাঁরা তাঁদের মতো করে, বাজার যা খায় সে ছবিই বানিয়েছেন। দোষ কারও নেই 'মা'। কারণ প্রচুর মানুষের পেট সে সময় বাংলা ছবির সঙ্গে জুড়ে ছিল। যেমন এখনও আছে। কিন্তু ঋতু এসে বললেন, বাজারে খাওয়ানোই শুধু কাজ নয়। শিল্পের প্রতি একটা দায় থাকে বইকি! তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন, ওই দেখো '১৯শে এপ্রিল'। ওই দেখো 'অসুখ'। ওই দেখো 'চোখের বালি'তে ভিজে যাচ্ছে রক্ত মাখা যোনি। ওই দেখো পর পুরুষের সামনেও কেমন অবলীলায় শাড়ি ছাড়ছে এক সন্তানের মা। কারণ সম্পর্ক মননে প্রবেশ করলে, শরীর তুচ্ছ। তিনি বোঝালেন, এক শরীরের নানা ভাষা। তিনি বোঝালেন মানসিক দ্বন্দের কথা। আবার নিজেই কল্পলোক রচনা করলেন। বনমালী হয়ে রাধাকে শরীরে ধারণ করলেন। এ বোঝার ক্ষমতা কি আজও হয়েছে, আমাদের হয়নি। তাই তাঁর সিনেমাকে ছুঁতে আমাদের এখনও সময় লাগবে। আমরা এখনও বুঝিনি 'ভালোবাসার সাহস' মানে আসলে কি !
advertisement
এ হেন ঋতুপর্ণ ঘোষ কিন্তু জীবনের শুরুটা করেছিলেন বিজ্ঞাপন জগত থেকে। ইকোনমিকসে এম এ করে ২৪ বছরের ঋতুপর্ণ রেসপন্সে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষানবিশ কপিরাইটার হিসেবে। ঝোলা বন্দি করে কিছু লেখা লেখি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ইনস্টারভিউ দিতে। তাঁকে চাকরিতে নেওয়া নিয়ে দ্বন্দ ছিল। কিন্তু কে জানত এই ছেলেই হবে বিজ্ঞাপনের অমূল্য রতন। শখের কলমবাজ থেকে পেশাদার হয়ে উঠতে সময় লাগেনি তাঁর। ঋতু ছন্দ কাটতেন খেলার ছলে, সে সাবান, তেল, রং বা ক্রিম যাই হোক না কেন। কপি লেখার জন্য যখন সকলে লাইবেরিতে ছুটছে, ঋতু তখন কলমে ফুলঝুরি তুলছে। একের পর এক অসাধারণ কপি। তাঁর লেখায় কোনও পুনরাবৃত্তি ছিল না। এই যেমন 'বোরলিন চিরদিন'। আজও অম্লান। তেমনই 'ত্বকের আপনজন' থেকে যাবে। তবে অনেকেই বলেন, "বঙ্গ জীবনের অঙ্গ' বোরোলিনের বিজ্ঞাপন এবং 'দেখতে খারাপ মাখতে ভালো' মার্গো সাবানের বিজ্ঞাপন ঋতুপর্ণর লেখা। তিনি অনেক স্মরণীয় লাইন লিখেছেন। কিন্তু এই দুটি বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন মধুছন্দা কার্লেকার। এই দুটি বিজ্ঞাপন ঋতুর নয়। সত্যিটাও জানা দরকার। কারণ না হলে ঋতুর অবমাননা হবে। সারা জীবন শিখতে চাইতেন ঋতু। আর সেই ইচ্ছেই তাঁকে সাধারণের থেকে আলাদা করেছে। সেই সঙ্গে ছিল বইয়ের প্রতি টান। সিনেমার প্রতি ভালোবাসা। অপর্ণা সেনের ছবি দেখেও অনুপ্রাণিত হয়েছেন ঋতু। ছুটে যেতেন প্রিয় রিনাদির দেখা পেতে। তাঁর মতো করে নিজেকে সাজাতে চাইতেন। আবার দু'জনে ঝগরাও করেছেন। কিন্তু শেষ বেলায় কোথায় আর রাগ, ঝগড়া! সব কিছুকে ফাঁকি দিয়ে, কাঁদিয়ে চলে গেলেন আদরের ঋতু। যে ঋতু ভালোবাসার সন্ধান করে গেছেন গোটা জীবন, তিনি বুঝতেই পারেননি তাঁকে ভালোবাসে গোটা বাংলা ছবির জগত। ঋতু যে ভাষায় বাংলা ছবি নিয়ে কথা বলা শুরু করেছিলেন, তা কিন্তু থেমেছে। বাংলা ছবি সাবলীল। সব কিছু এখন সহজে দেখানো হয়। কিন্তু সেই মননশীলতা কই ! না, এটা ঋতুর যাওয়ার সময় ছিল না। অনেক কিছু বাকি থেকে গেল ! 'বনমালী' তুমি 'রাধা বা 'কৃষ্ণ' কিম্বা গৌরাঙ্গ যে রূপেই হোক, পারলে ফিরে এসো !