৮৭ বছরে পা দিলেন লতা মঙ্গেশকর ৷ জন্মদিনের সকালে সংবাদ মাধ্যমকে তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, ‘তীব্র নিন্দা করি উরি জঙ্গি হামলার ৷ শহিদ হওয়া সেনাদের জন্য আমি শোকাহত ৷ অআমার জন্মদিনে দয়া করে কোনও ফুল পাঠাবেন না, সেই টাকা শহিদদের পরিবারের মানুষদের পাঠিয়ে দিন৷ তাহলেই আমি খুশি হব ৷’ নিজের গাওয়া গানের লাইন তুলে লতাজি বললেন, ‘জো শহিদ হুয়ে হ্যায় উনকি যারা ইয়াদ করো কুরবানি ৷’
advertisement
‘মেরি আওয়াজ হি পহেচান হ্যায়’, জন্মদিনে লতা মঙ্গেশকর
তাঁর গলায় সরস্বতীর অবস্থান। ভারতের নাইটিঙ্গল তিনি। তাঁর সুরের জাদুতে আজও আচ্ছন্ন হয় গোটা দেশ। লতা মঙ্গেশকর। সুর সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন সুরের এক বর্ণময় উজ্জ্বল অধ্যায়।
খুব ছোটবেলা থেকেই সংগীতের হাতেখড়ি। প্রথমে বাবা দীনানাথ মঙ্গেশকরের কাছে সংগীতশিক্ষা। তারপর উস্তাদ আমানত আলির কাছে সংগীতের তালিম নেওয়া। তেরো বছর বয়সে বাবার মৃত্যু এক লাফে বাস্তবের মাটিতে নিয়ে এল লতাকে। শুরু হল লড়াই। চোদ্দ বছর বয়সে প্রথম প্লেব্যাক মারাঠি ছবিতে। হিন্দি প্লেব্যাকে প্রথম গান আপ কী সেবা মে। তবে লতা সবার কাছে পরিচিত হলেন মহল ছবিতে।
এরপর ধীরে ধীরে লতা মঙ্গেশকরের ছায়া দীর্ঘ হতে থাকল মুম্বই ইন্ড্রাস্ট্রিতে। পঞ্চাশ দশকে লতার গানের স্বর্ণযুগ বলে মনে করেন অনেকেই। যা গেয়েছেন তাই সুপার ডুপার হিট হয়েছে। সেই সময় এস ডি বর্মনের সান্নিধ্যে লতা একের পর এক চিরনতুন গান উপহার দেন।
লতা মঙ্গেশকরকে বঙ্গবিভূষণ সম্মান !
সেই সময় লতার কেরিয়ারের নৌশাদের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। বৈজু বাওয়া, মাদার ইন্ডিয়া প্রভৃতি ছবিতে লতা মঙ্গেশকর তাঁর গানের জাদুতে সকলকে মোহিত করে দেন। সেই সময় বলিউড শাসন করছেন বাঙালিরা। উনিশশো ছাপ্পান্ন সালে লতা প্রথম গান গান রেকর্ড করেন। গানটি হল আকাশ প্রদীপ জ্বলে।
দিদির সেক্রেটারির প্রেমে পড়েছিলেন আশা ভোঁসলে !
এরপরেই লতার পরিচয় হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্ত আর লতা জুটি বোধহয় বাংলা ও হিন্দিতে সবচেয়ে বেশী হিট গান উপহার দিয়েছেন। সেই সম্পর্কে সুর আর কথা জাদুতে আজও মোহিত হয় বাঙালি।
আরও একজনের কথা না বললে লতা মঙ্গেশকরের সংগীতজীবন অপূর্ণ থাকে তিনি আর কেউ নন, সলিল চৌধুরী। বাংলা ও হিন্দি দুটি সংগীতের মাধ্যমেই লতা মঙ্গেশকরকে এক উচ্চতায় তুলে নিয়ে যান এই সংগীতশিল্পী। উনিশশো উনষাট সালে সলিল চৌধুরীর সুরেই প্রথম বাংলা গান না যেও না রজনী এখনও বাকি গানটি গান লতা।
এরপরেই লতা জুটি বাঁধেন মদন মোহনের সঙ্গে। এই সংগীতশিল্পী বোধহয় লতার জীবনের ধ্রুবতারা হয়ে নেমে আসেন। লতা জীবনের সেরা গানগুলি মদন মোহনের সুরেই গান।
শুধুমাত্র সংগীত পরিচালকই নয়, লতা মঙ্গেশকরের গায়কি ও সুর মুর্চ্ছনা যে কোনও সাধারণ গানকে অসাধারণ উচ্চতায় তুলে দিয়েছিল। সংগীত পরিচালকরা বার বার স্বীকার করেছেন যে লতা গান গাওয়া মানে তাঁদের সুরকে মর্জাদা দেওয়া।
তবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য লতা মঙ্গেশকরকে লড়াই কম করতে হয়নি। শুরুতে শামসেদ বেগম ও পরে গীতা দত্তের সঙ্গে তাঁর তীব্র প্রতিযোগীতা ছিল। গীতা দত্তের অকাল প্রয়াণ লতাকে এগিয়ে দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। পরবর্তী সময়ে আশা ভোঁসলের সঙ্গেও তাঁর লড়াই লোকের মুখে মুখে ফেরে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুম্বই ইন্ড্রাস্টির পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু লতা মঙ্গেশকের কণ্ঠের কোনও পরিবর্তন হয়নি। যে মেয়েটি চোদ্দ বছর বয়সে মহল ছবিতে গান গাইছেন। সেই গায়িকা চুয়াল্লিশ বছর বয়সে ডিম্পল কাপাডিয়ার লিপে গান গাইছেন ববি ছবিতে। আবার পঁচাত্তর বছর বয়সে বীর জারা ছবিতে প্রীতি জিন্টার লিপে গান গাইছেন লতা মঙ্গেশকর এটাই ম্যাজিক।
বাংলা ছবিতে লতা মঙ্গেশকর কিন্তু নিজের গায়কী একইভাবে প্রতিভাত হয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানে লতা মঙ্গেশকরের ছিল অবাধ বিচরণ। সাত ভাই চম্পা হোক কিংবা আকাশ প্রদীপ জ্বলে, প্রতিটি গানেই লতা মঙ্গেশকর নিজ স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।
উনিশশো চুয়াত্তর সাল থেকে উনিশশো একানব্বই এই সময় তিরিশ হাজার গান গেয়ে গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তোলেন সুরসাম্রাজ্ঞী। গোটা জীবনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার গান গেয়েছেন এই সংগীতশিল্পী
যশ চোপড়া একসময় বলেছিলেন সব শিল্পী সংগীতকে অনুসরণ করে কিন্তু সংগীত অনুসরণ করে লতা মঙ্গেশকরকে। কথাটা হয়তো একদিন থেকে সত্যি। কারণ সুরের মধ্যে যদি সত্যিই সরস্বতীর বাস হয়, তাহলে লতা মঙ্গেশকর সাক্ষাৎ সরস্বতী। আর তাঁকেই এবার বাংলার তরফে বঙ্গভূষণ সম্মাণ দিতে পেরে গর্বিত আমরাও।